কেন আমরা শ্যামলা, আফ্রিকানরা কালো, আর ইউরোপিয়ানরা ফরসা?

কেন আমরা শ্যামলা – মনুষ্যের সাড়ে ৩ কেজি ওজনের জটিল মস্তক যাহা বিশাল দেহকে চালাচ্ছে তাহা আরেক বিশাল আচ্ছাদন দ্বারা আবৃত। উহাকে মনুষ্যগণ চর্ম বলিয়া সম্মোধন করিয়া থাকে। এই বিশাল অঙ্গখানি একদিকে বড়ই দুঃখী আবার বড়ই অহংকারী কেননা উহার বর্ণ দেখিয়া মনুষ্যগণ তাহাদের সম্মান নির্ধারণের একখানা জটিল এবং কুটিল কৌশল আবিষ্কার করিয়াছে।

এই আবিষ্কারের গোঁড়া খুঁজিতে গিয়া দেখিলাম যে মনুষ্য এবং উহাদের চর্মবর্ণের আরেকখানা কাহিনী পড়িয়া রহিয়াছে আমাদিগকের চক্ষুর অন্তরালে। ইহা বহু লক্ষ বৎসর আগেকার কথা। ছয় কিংবা সাত তো হইবেই। তৎকালীন জংলাকীর্ণ পৃথিবীর মধ্যাঞ্চলের জঙ্গলসমূহে এক প্রজাতির লোমশ স্তন্যপায়ী প্রাণী পশ্চাতের দুই পায়ে সর্বক্ষণের জন্য কেমনে জানি হাঁটিতে শিখিয়া ফেলিল।

মনুষ্য পন্ডিতগণ ইহার নাম দিয়াছেন “Homini”। ইহার বাঙ্গালা করিলে অর্থ দাঁড়ায় “বিরাট মস্তিষ্ক”। বিরাট মানে মনুষ্য মস্তিষ্ক অপেক্ষা বিরাট। কিন্তু কি কারণে যে ইহারা এই বিরাট মস্তিষ্ক লইয়া কিছুই করিতে পারিল না সে সম্পর্কে আমার ধারণা সীমিত।

যাহাই হোক, এই দ্বিপদী স্বভাবের কারণে তাহাদের অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসিল। অন্যান্য প্রাণীর চাইতে বেশি পরিশ্রম করিতে শিখিল। অতি পরিশ্রমের সহিত তাল মিলাইয়া অতিরিক্ত ঘাম ঝড়াইবার জন্য এবং কাজ কর্মের সুবিধার্থে মনুষ্য বৈজ্ঞানিক ডারউইন সাহেবের মতানুযায়ী ইহাদের দেহে লোম ক্রমশ সরু হইয়া কমিয়া আসিতে লাগিল।

এক পর্যায়ে রৌদ্রতাপে মস্তিষ্ককে ক্ষতি হইতে বাঁচাইবার নিমিত্তে কেবল মাথা ছাড়া সমগ্র দেহে লোম কমিয়া আসিল। ফলে প্রচুর ঘাম হইবার সুযোগ হইল। এই হ্রাস পাইবার ঘটনা কয়েকশত বা কয়েক সহস্র নহে বরং কয়েক লক্ষ বৎসর ধরিয়া ধীরে ধীরে চলিতেছিল।

ইহার পরে ঘটনা সংক্ষেপের নিমিত্তে আমরা এক লাফে ৫ লক্ষ বৎসর আগাইয়া আসি। বৈজ্ঞানিকগণ উহাদের প্রাপ্ত Homo hidelbergenesis নামক মনুষ্য পূর্বপুরুষের প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসরের পুরাতন একখানি কংকাল বিশ্লেষণপূর্বক বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করিয়াছেন।

তাঁহাদের ভূয়োদর্শন এবং প্রাচীন উদ্ভিদকাষ্ঠ পর্যবেক্ষণপূর্বক বলা যাইতেছে যে সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষ বাঁচিয়া থাকা অবস্থায় সমগ্র পৃথিবীতে বেশ কয়েকখানা মহাখরা (Mega drought) হইয়াছিল।

কোন এলাকায় একটানা প্রায় দুই যুগব্যাপী কোনরূপ বৃষ্টিবাদল এবং তাপমাত্রা পরিবর্তন না হইয়া থাকাকে মহাখরা বলা হয়। এই মহাখরায় অপেক্ষাকৃত লোমহীন মনুষ্য পূর্বপুরুষগণের চর্ম সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি হইতে দেহকে সুরক্ষিত রাখিবার নিমিত্তে প্রচুর পরিমাণ মেলানিন নামক রঞ্জক তৈরি করিয়াছিল।

সেই সময় হইতেই মনুষ্যের পূর্বপুরুষগণের চর্ম শ্যামবর্ণ (কালো) ধারণ করে। এর আরও প্রায় ৩০ হাজার বৎসর পরের কথা, আরো অধিকতর বুদ্ধিসম্পন্ন প্রজাতি Homo Ergaster এর আবির্ভাব ঘটে। ইহারা চলনে বলনে কিছুটা উন্নত। কিঞ্চিত ধ্বনি করিতে শিখিয়াছে, ইশারা ইঙ্গিতে ভাব বুঝাইতে জানে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে সংগ্রামে ইহারা ইহাদের পূর্বপুরুষগণের মতই বিফল। ইহারাও শ্যামবর্ণের ছিল।

ইহাদেরও ৩০-৪০ হাজার বৎসর পরে অতিচতুর ও কূটিল, উদ্ভাবনপ্রিয়, অনুসন্ধিৎসু আর ভ্রমনপ্রিয় Homo sapiens এর আগমন । ইহারা একস্থানে বসিয়া থাকিবার পক্ষপাতী নহে। মাথায় খালি বিভিন্ন চিন্তা ঘুরে।

বৃক্ষডালে রাত্রিযাপনের চাইতে পর্বতের গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়া যে উহাকে নিরাপদ আবাসস্থল বানানো যায় সেটা বুঝিয়া ফেলে। পশুর সাথে দল বাঁধিয়া যুদ্ধ করিয়া দিন কাটায়। এরই মধ্যে সুযোগে দুই একটাকে মারিয়া ঘপাঘপ কাঁচা মাংস মুখে পুরিয়া উদরপূর্তি করে। ইহারা আধো-আধো ভাষা আয়ত্ত্ব করিয়াছে।

মাটিতে পাথরে বা বৃক্ষকান্ডে আঁকিবুঁকি করিতে শিখিয়াছে। এমতাবস্থায় ইহারা বিশাল বিশাল কাঠের ভেলা বানাইয়া কিংবা পায়ে হাঁটিয়া পৃথিবীর মধ্যিখানের এলাকা হইতে বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমানো আরম্ভ করিল। বিশেষ করিয়া পৃথিবীর উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলোই এদের গন্তব্য কারণ দক্ষিণাঞ্চলে অকূল সমুদ্র।

ভৌগলিক কারণে পৃথিবীর ক্রমশ উত্তরদিকে সূর্যালোকের তেজ কমিতে থাকে ফলে অতিবেগুনী রশ্মি কম পতিত হয়। উত্তরে স্থানান্তরিত Homo sapiens গণ কম সূর্যালোকে ঠাণ্ডার কারণে মোটা বস্ত্রাদি ব্যবহার করা শিখিয়া ফেলে।

এই বস্ত্রাদির কারণে তাহাদের চর্মে সূর্যালোক আরও কম পতিত হয়। তাছাড়া ক্রমশ হাজার বৎসর ধরিয়া কম রোদে থাকিবার অভ্যাসের কারণে বৈজ্ঞানিক ডারউইনের মতানুযায়ী ইহাদের চর্ম অতিবেগুনী রশ্মি প্রতিবন্ধকতার জন্য উৎপাদিত মেলানিন রঞ্জক তৈরি কমাইয়া দেয়। ফলে মেলানিনের অভাবে ইহাদের চর্ম কিঞ্চিৎ শ্বেত হইয়া উঠে।

ইতোমধ্যে ইহারা চাষবাসের বুদ্ধি আয়ত্ত্ব করিয়া ফেলিয়াছে উপরন্তু উত্তরাঞ্চলে মধ্যাঞ্চলের ন্যায় শিকারোপযোগী পশুর অভাবে ক্রমে ইহারা শস্যের উপর বেশি নির্ভরশীল হইয়া পড়ে।

ফলে দেহে ভিটামিন ডি এর অভাব দেখা দিল যেটা পরোক্ষভাবে ক্যালসিয়ামের অভাবে পরিণত হইল কেননা ভিটামিন ডি এর অধিকাংশ উৎস প্রাণীজ। কিন্তু যেহেতু মনুষ্য চর্ম সূর্যালোক হইতে ভিটামিন ডি তৈরিতে পটু এবং মেলানিন রঞ্জকের স্বল্প ঘনত্ব অতিরিক্ত সূর্যালোক চামড়ায় ঢুকাইয়া বেশি পরিমাণ ভিটামিন ডি তৈরিতে অবদান রাখে সেহেতু এই ভিটামিন ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে উত্তরাঞ্চলের মনুষ্য চর্ম হইতে ক্রমশ মেলানিন রঞ্জক আরও কমিয়া ইহাদের শ্বেতাঙ্গ করিয়া তুলে। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক।

মনুষ্যের স্ত্রীগণের সন্তান ধারণ ও স্তন্যপান করাইবার জন্যে প্রচুর ক্যালসিয়াম প্রয়োজন যা তৈরি বা শোষণের জন্যে ভিটামিন ডি দরকার। এই অতিরিক্ত ভিটামিন ডি সরবরাহের জন্যে স্ত্রীগণ উপরোক্ত কারণে পৃথিবীব্যপী পুরুষদিগের অপেক্ষা অধিকতর শ্বেতবর্ণের হয়।

এখন কথায় ফিরিয়া আসি। এই শ্বেতাঙ্গ মনুষ্যগণের দেহে মেলানিনের স্বল্প ঘনত্বের কারণে প্রচুর ক্যালসিয়াম বর্তমান থাকায় ইহারা তুলনামূলক বুদ্ধিমান, সুঠাম ও পরিশ্রমী হয়। ইহার ফলে শ্বেতাঙ্গগণ মনুষ্যসমাজে দ্রুত উন্নতি করিয়াছে এবং ইহাই স্বাভাবিক।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া পড়া এই মনুষ্যগণের চর্ম সূর্যালোকের তীব্রতার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকারের হইয়াছে। তবে স্থায়ীভাবে চর্মের বর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে আজ হইতে প্রায় ৬- ১২ হাজার বৎসরের মধ্যকার সময়ে। তবে সম্প্রতি Shanidar-1 নামক ৭০ হাজার বৎসরের প্রাচীন এক মনুষ্য ফসিল বিশ্লেষণপূর্বক তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ মনুষ্যের অস্তিত্ব অনুমিত হইয়াছে।

পরবর্তী কাহিনিসমূহ অতি সংক্ষেপ করিয়া বলা যায়, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ নিশ্চিত হইয়াছেন যে KITLG এবং ASIP নামক মনুষ্য কোষের দুইখানা জীনের বিবর্তন এই শ্বেতাঙ্গদিগের চর্মবর্ণ গঠনে মূখ্য ভূমিকা রাখিয়াছে। অনুরূপভাবে MC1R জীনের বিবর্তন শ্যামবর্ণদিগের (প্রধানত) চর্মের বর্ণ গঠনে মূখ্য ভূমিকা রাখিয়াছে।

অবশেষে আজিকালকার দিনে এই অতিবুদ্ধিমান Homo sapiens প্রজাতি অন্যান্য সকল প্রাণী গোষ্ঠীর উপর নিজ মস্তিষ্কবলে প্রভুত্ব খাটাইতেছে। তারই সাথে আপনাদিগের প্রাকৃতিকভাবে গঠিত চর্মবর্ণ নিয়া সুন্দর এবং অসুন্দর নামক দুইখানা পার্থক্য বাহির করিয়াছে। উহারা শ্বেতাঙ্গদিগকে সুন্দর পর্যায়ে ফেলিয়াছে আর শ্যামবর্ণগণ উহাদিগকে অনুসরণপূর্বক বহু মূল্যবান প্রসাধন সামগ্রী চর্মে মর্দন করিয়া প্রাণপণে শ্বেতাঙ্গ হইবার চেষ্টায় আছে।

যাহাই হোক, কথন এখানেই শেষ করিলাম। তবে পাঠক পাঠিকাগণ কেহকে প্রহারপূর্বক উহার পৃষ্ঠ ও নিতম্ব হইতে চর্ম তুলিয়া লইবার হুমকি না দিয়া পারিলে একবার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত সাতশত বৎসরের পুরাতন চারিখানি মনুষ্য চর্ম দিয়া বাঁধাইকৃত পুস্তক দেখিয়া আসিবেন।

তথ্যসূত্রঃ

১) International Journal Of Dermatology (2007)

২) The Forgotten Roots Of Color Prejudice: Frost,P (2005)

৩) The American Journal Of Human Genetics (2000)

৪) The American Journal Of Clinical Nutrition (2000)

৫) Living Color By Jablonski Nina (January 2014)

৬) Wikipedia

শেয়ার করুন: