বিনোদন

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : এর পেছনের ঘটনাটি জানলে অবাক হবেন!

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জায়গা হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ । কিন্তু ওই ঘর যদি কেউ ভেঙে দেয় তা হবে খুবই নিকৃষ্ট কাজ। বলছিলাম ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদের কথা। এই মসজিদ ভাঙতে প্রথম আঘাত করেছিলেন যে ব্যক্তি তার নাম বলবির সিং।

কিন্তু মহান আল্লাহ’র অশেষ রহমতে সেই বলবির সিং আজ নওমুসলিম মুহাম্মদ আমের। যে ব্যক্তি একদিন মসজিদ ভেঙে দিয়েছিলে তিনিই এখন পথে পথে ঘুরে আল্লাহ’র ঘর পুনর্নির্মাণ ও নতুন মসজিদ নির্মাণ করছেন। কিন্তু কিভাবে তার এই বদলে যাওয়া, আসুন জেনে নেই।

মুহাম্মদ আমের : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আহমদ আওয়াহ : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

প্রশ্ন : প্রথমে আপনার পরিচয় দিন।

উত্তর : জন্মসূত্রে আমার নাম বলবির সিং । ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ জেলার এক রাজপুত পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। যেকোনো ধরণের জুলুম-নিপীড়নের বিরোধী ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তিনি দেখেছিলেন। সে সময়কার ব্যপক মুসলিম হত্যাকে দেশের জন্য বড় ধরনের কলঙ্ক মনে করতেন তিনি। অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তিনি খুবই সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের মুসলমান ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতেন।

গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে আমি পানিপথে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। মুম্বাইয়ের পর পানিপথ ছিল শিবসেনার সবচেয়ে মজবুত কেন্দ্র। বিশেষ করে যুবক শ্রেণী ও স্কুলের লোকেরা শিবসেনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। অনেক শিবসেনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং আমিও পানিপথ শাখায় আমার নাম লেখাই।

পানিপথের ইতিহাস তুলে ধরে সেখানকার যুবকদের মধ্যে মুসলিম সম্রাটদের বিরুদ্ধে বিরাট ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ান হতো। আমার বাবা যখন জানতে পারলেন যে, আমি শিবসেনায় নাম লিখিয়েছি তখন তিনি আমাকে ইতিহাসের সূত্র ধরে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।

সম্রাট বাবর বিশেষ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ন্যায় ও ইনসাফ এবং অমুসলিমদের সঙ্গে করা তার আচরণের কাহিনী তিনি আমাকে শোনান এবং আমাকে বলতে চেষ্টা করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়কার জুলুম-নিপীড়ন, হত্যা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী শুনিয়ে আমাকে শিবসেনার যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার বাবার সেসব চেষ্টা বিফলে যায়। আমার উপলব্ধিতে কোনো কিছুই ধরা পড়েনি।

প্রশ্ন : ফুলাত থাকাকালে বাবরি মসজিদ ভাঙার ক্ষেত্রে আপনার অংশগ্রহণের কথা শুনিয়েছিলেন। এবার একটু বিস্তারিতভাবে সে সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন।

উত্তর : ঘটনাটি এ রকম, ৯০ সালে লালকৃঞ্চ আদভানির রথযাত্রায় আমাকে পানিপথের কর্মসূচী সফল করার ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। রথযাত্রায় দায়িত্বশীল নেতারা আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেন।

আমি শিবজীর নামে শপথ গ্রহণ করি যে, যাই কিছু ঘটুক না কেন আর কেউ কিছু করুক আর নাই করুক, আমি একাই গিয়ে রাম মন্দিরের ওপর থেকে জুলুম করে চাপিয়ে দেয়া (মসজিদের রূপে) অবকাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ি দেবই। এ যাত্রায় আমার কর্মতৎপরতার ফলে আমাকে শিবসেনার যুব শাখার সহ-সভাপতিনির্বাচিত করা হয়।

আমি আমার যুব টিম নিয়ে ৩০ অক্টোবর অযোধ্যায় গিয়ে পৌঁছি। বহু চেষ্টা করেও আমি বাবরি মসজিদের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। এর ফলে আমার শরীরে ঘৃণা ও বিদ্বষের আগুন আরো জ্বলে ওঠে।

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : এর পেছনের ঘটনাটি জানলে অবাক হবেন!

আমি আমার সাথীদেরকে বারবার বলছিলাম এরকম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। রামের জন্মভূমিতে আরবদের কারণে রামভক্তদের ওপর গুলি চলবে, এ কেমন অন্যায় ও জুলুম!

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি রাগে ক্ষোভে ফুসছিলাম।কখনো মনে হচ্ছিল যে, আমি নিজেকেই শেষ করে দেই। আমি আত্মহত্যা করি। সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল।

আমি সেদিনের জন্য খুবই অস্থির ছিলাম যেন আমার সুযোগ মিলে যায় আর আমি নিজ হাতে বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেই। এভাবে একদিন দু’দিন করে সেই অপেক্ষার দিনটিও কাছে এসে পড়ল, যে দিনটাকে আমি সে সময় খুশির দিন ভাবতাম। আমি আমার কিছু আবেগ-দীপ্ত সাথীকে নিয়ে ৯২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথমে অযোধ্যায় যাই।

আমার সাথীদের মধ্যে যোগীন্দর পাল নামে এক যুবক ছিলেন। তার বাড়ি সোনীপথের নিকটবর্তী জাটদের গ্রামে। সে ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার বাবা ছিলেন একজন বিরাট জমিদার।

জমিদার হলেও তিনি মানুষকে খ্বু ভালবাসতেন। তিনি তার একমাত্র ছেলেকে অযোধ্যায় যেতে বাধা দেন। তার বড় চাচাও তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কোনো বাধা মানেনি।

আমরা ৬ ডিসেম্বর আগের রাত্রে বাবরি মসজিদের একবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছি এবং মসজিদের সামনে কিছু মুসলমানদের বাড়ির ছাদে রাত কাটাই। আমার বারবার মনে হত, না জানি আমাদেরকে ৩০ অক্টোবরের মত আজও এই ‘শুভ’ কাজ থেকে বঞ্চিত হতে হয়! কয়েকবারই মনে হয়েছে, নেতা না জানি কী করেন, আমাদরে নিজেদের গিয়েই কর সেবা শুরু করা উচিত।

কিন্তু আমাদের নেতা আমাদেরকে বাধা দিলেন এবং শৃংখলার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি তার ভাষণ শুনতে শুনতে ঘরের ছাদ থেকে নেমে এলাম এবং কোদাল হাতে বাবরি মসজিদ ভাঙতে অগ্রসর হলাম।

আমার মনের বাসনা পূরণের সময় এলো। আমি মাঝের গম্বুজটির ওপর কোদাল দিয়ে আঘাত করলাম এবং ভগবান রামের নামে জোরে জোরে ধ্বনি দিলাম। দেখতে না দেখতেই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

মসজিদ ভেঙে পড়ার আগেই আমরা নিচে নেমে পড়ি। আমরা খুবই আনন্দিত ছিলাম। রাম লীলা লাগানোর পর তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আমারা আমাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে এলাম।

সাথে করে নিয়ে এলাম মসজিদের দু’টুকরো করে ইট, যা আমরা খুশিমনে আমাদের পানিপথের সাথীদের দেখালাম। তারা আমাদের পিঠ চাপড়ে আমাদের কৃতিত্বে আনন্দ প্রকাশ করল। শিবসেনার অফিসেও দুটি করে ইট রেখে দেয়া হয়।

এরপর এক বিরাট সভা হয় এবং সকলেই তাদের বক্তৃতায় অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। আমি আমার বাড়ি গিয়েও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গ একথা বলে ছিলাম।

আমার বাবা খুব অসন্তুষ্ট হন। এ ব্যাপারে তার গভীর দুঃখের কথা জানিয়ে আমাকে পরিষ্কার বলে দেন, এখন এই ঘরে আমি আর তুমি দু’জনে এক সঙ্গে থাকতে

বুধবার সকালে যোগীন্দরের বাবা ছেলেকে নিয়ে সেই মাদ্রাসায় গিয়ে মাওলানা সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। দুপুর বেলা যোহরের আগেই মাওলানা সাহেবের আগমন ঘটে। শেকলে বাধা যোগিন্দর সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় দাঁড়ানো। চৌধুরী সাহেব কাঁদতে কাঁদতে মাওলানা সাহেবের পায়ে ওপর পড়ে যান এবং বলতে থাকেন, মাওলানা সাহেব!

আমি এই আহম্মকটাকে খুবই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে পানিপথের এক কুচক্রীর চক্রান্তে পড়ে। মাওলানা সাহেব! আমার ওপর দয়া করুন। আমাকে মার্জনা করে দিন। আমার ঘর বাঁচান। মাওলানা সাহেব কঠোর ভাষায় তাকা মাথা তুলতে বলেন এবং পুরো ঘটনা শোনেন।

তিনি চৌধুরী সাহেবকে বলেন যে, সমগ্র জগত সংসার নিয়ন্ত্রণকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তারা এত বড় পাপ করেছে এবং এত বড় জুলুম করেছে যে, যদি তিনি গোটা বিশ্বচরাচর ধ্বংস করে দেন তাহলে তা যথার্থ হবে। এতো বরং কমই হয়েছে যে, এই পাপের বোঝা কেবল একাকী তার ওপর পড়েছে।

আমরাও সেই সর্বশক্তিমান মালিকের বান্দা এবং এক দিক থেকে এই বিরাট পাপের অংশীদার আমরাও। আর তা এই দিক দিয়ে যে, আমরা তাদেরকে বোঝাবার হক আদায় করিনি যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে। এখন আমাদের আয়ত্বে আর কিছুই নেই। আমরা কেবল এতটুকু করতে পারি যে. আপনি সেই মালিকের সামনে কাঁদেন এবং তার কাছে ক্ষমা চান। আর আমরাও ক্ষমা চাই।

এরপর মাওলানা সাহেব বললেন, মসজিদের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি মালিকের কাছে অন্তর দিয়ে মাফ চান। প্রার্থনা করতে থাকুন যে, মালিক! আমার বিপদ কেবল আপনিই দূর করতে পারেন, আর কেউ দূর করতে পারে না।

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : এর পেছনের ঘটনাটি জানলে অবাক হবেন!

মাওলানা সাহেব মসজিদে গেলেন। নামায পড়লেন। অল্প সময়ের জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে বক্তৃতাও দিলেন এবং দোয় করলেন। মাওলানা সাহেব সকলকেই যোগিন্দর ও তার বাবার জন্য দোয়া করতে বললেন। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর মসজিদে নাশতা হল।

নাশতা থেকে মুক্ত হবার পর মসজিদ থেকে বরে হতেই আল্লাহর কী মেহেরবানি দেখুন, যোগীন্দর তার বাবার মাথা থেকে পাগড়ি টেনে নিয়ে তার উলঙ্গ শরীর ঢাকল এবং দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো তার বাবার সাথে কথা বলতে লাগল। সকলেই এ দৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেন।

মাদ্রাসার ইমাম সাহেব যোগীন্দরের বাবাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, যেই মালিক তাকে ভালো করে দিয়েছেন, আপনি যদি ওয়াদা মাফিক মুসলমান না হও তাহলে সে আবার এর চেয়েও মারাত্মক পাগল হতে পারে।

এরপর যোগীন্দরের বাবাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হতেই যোগিন্দর জিজ্ঞেস করল, বাবা! আপনি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, মুসলমান হতে। তখন যোগিন্দর বলল, আমাকে তো আপনার আগে মুসলমান হতে হবে এবং আমাকে বাবরি মসজিদ পূর্ণবার অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। তারপর তারা উভয়ে খুশি মনে ওযু করলেন। তাদেরকে কলেমা পড়ানো হল।

বাবার নাম মুহাম্মদ উসমান এবং ছেলের নাম মুহাম্মদ ওমর রাখা হল। এরপর তারা খুবই খুশি হয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেলেন। গ্রামে একটি ছোট মসজিদ ছিল।

তারা মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ইমাম সাহেব স্থানীয় মুসলমানদেরকে তাদের বাপ বেটার মুসলমান হবার কথা জানিয়ে দিলেন। ফলে একজন দু’জনের কান থেকে গোটা এলাকায় একথা ছড়িয়ে পড়ল।

হিন্দুদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে এলাকার প্রভাবশালী হিন্দুদের এ নিয়ে মিটিং হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাদের দু’জনকেই রাতের বেলা মেরে ফেলতে হবে।

অন্যথায় তাঁরা অনেক লোকের ধর্ম নষ্ট করে দেবে। তাদের এই মিটিংয়ে একজন ধর্মত্যাগী উপস্থিত ছিল। সে ইমাম সাহেবকে গোপনে তাদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দেয়। ফলে আল্লাহর মেহেরবানিতে রাতের অন্ধকারে তাদেরকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা ফুলাত গিয়ে পৌঁছেন।

পরে তাদেরকে ৪০ দিনের জন্য তাবলিগ জামায়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর আমীর সাহেবের পরামর্শে যোগীন্দর (ওমর) তিন চিল্লাও দেয়। পরে যোগীন্দরের মা-ও মুসলমান হয়ে যায়।

এরপর মুহাম্মদ ওমরের (যোগিন্দর) বিয়ে হয় দিল্লীর এক ভালো মুসলিম পরিবারে। এখন তারা বেশ আনন্দের সঙ্গেই দিল্লিতে সপরিবারে বসবাস করছেন। গ্রামের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি সব বিক্রি করে তারা দিল্লীতে একটি কারখানা দিয়েছেন।

প্রশ্ন : মাস্টার সাহেব! আমি আপনাকে আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনি কিভাবে মুসলমান হলেন? আপনি যোগীন্দরের ও তার পরিবারের (মুসলমান হবার) কাহিনী শোনালেন।

যদিও তা খুবই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর, কিন্তু আমি তো আপনার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাই, কিভাবে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন সে সম্পর্কে।

উত্তর : প্রিয় ভাইটি আমার! আসলে আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এর থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এজন্য আমি এর প্রথম অংশ শোনালাম। এখন দ্বিতীয় অংশ শুনুন।

১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ আমার বাবা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়া এবং তাতে আমার অংশ গ্রহণ তাকে খুবই আঘাত দিয়েছিল।

তিনি প্রায়ই আমার মাকে বলতেন, মালিক আমাকে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম দিলেন না কেন? আমি যদি মুসলমানদের ঘরে জন্ম নিতাম তাহলে অন্তত জুলুম-নিপীড়ন সহ্যকারীদের তালিকায় আমার নাম থাকত।

তিনি আমার পরিবারের সদস্যদের বলে গিয়েছিলেন, আমি মারা গেলে আমার লাশের কাছে যেন বলবীর না আসে, প্রথা ও রেওয়াজ মাফিক আগুনে যেন পোড়ানো না হয়। হিন্দুদের শ্মশানে যেন না নেয়া হয়। পরিবারের লোকেরা তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ি সব কিছু করে।

আট দিন পর আমি আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পাই। এত আমার মন ভেঙে যায়। তার মৃত্যুর পর বাবরি মসজিদ ভাঙা আমার কাছে জুলুম মনে হতে থাকে এবং গর্বের বদলে আফসোস হতে থাকে। আমার অন্তর যেন হঠাৎ দ্প কের নিভে যায়।

আমি বাড়ি গেলে মা আমার বাবার কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকেন এবং বলতে থাকেন এমন একজন ভালো মানুষকে তুই কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললি! তুই কতটা নিচ ও হীন জাতের মানুষ। মায়ের এ ধরনের আচারণের কারণে আমি বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেই।

জুন মাসে মুহাম্মদ ওমর (যোগিন্দর) তাবলিগ জামায়াত থেকে ফিরে এলো। সে পানিপথে আমার সঙ্গে দেখা করল এবং তার পুরো ঘটনা আমাকে বলল। বিগত দু’মাস থেকে আমার মন সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত,

না জানি কোনো আসমানি বালা-মুসবিত আমার ওপর এসে পড়ে। বাবার দুঃখ ও মনোকষ্ট এবং বাবরি মসজিদ ভাঙার দরুন আমার মন সব সময় খারাপ থাকত। মুহাম্মদ ওমরের কথা শুনে আমি আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

ওমর ভাই আমাকে বললেন, আমি যেন ২৩ জুন সোনিপথে মাওলানা সাহেবের সাথে গিয়ে অবশ্যই দেখা করি। আরো ভালো হয় যদি তার সঙ্গে আমি কিছু দিন থাকি। আমি প্রোগ্রাম বানালাম। কিন্তু পৌঁছতে আমার কিছুটা দেরি হয়। ওমর ভাই আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল এবং মাওলানা সাহেবকে আমার অবস্থা সম্পর্কে সব বলেছিল।

আমি সেখানে গেলে মাওলানা সাহেব আমাকে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, যোগিন্দরের সঙ্গে সর্বময় মালিক যা করেছেন আপনার সঙ্গেও একই রূপ ব্যবহার করা হতে পারে। আর মালিক যদি এই জগতে শাস্তি নাও দেন তাহলে মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী জীবনে যেই শাস্তি মিলবে আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না।

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : এর পেছনের ঘটনাটি জানলে অবাক হবেন!

এক ঘন্টা মাওলানা সাহেবের সাথে থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আসমানি বালার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে । মাওলানা সাহেব দু’দিনের জন্য বাইরে কোনো সফরে যাচ্ছিলেন। আমি তার সাথে যেতে চাইলাম। তিনি খুব খুশি হয়েই অনুমতি দিলেন।

একদিন হরিয়ানা, এরপর দিল্লী ও খোর্জার সফর ছিল। দু’দিন পর তিনি ফুলাত ফিরে এলেন। এ দু’দিন আমার মন ইসলাম গ্রহণের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি ওমর ভাইকে আমার ইচ্ছার কথা বললাম। সে খুব খুশি হয়ে মাওলানা সাহেবকে তা জানাল।

আলহামদুলিল্লাহ! ২৫ জুন ১৯৯৩ যোহর নামাযের পর আমি ইসলাম কবুল করি। মাওলানা সাহেব আমার নাম রাখেন মুহাম্মদ আমের। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা এবং নামাযের নিয়ম-কানুন ও দরকারি মাসলা-মাসায়েল শেখার জন্য তিনি আমাকে কিছুদিন ফুলাত থাকার পরামর্শ দিলেন। আমি আমার স্ত্রী ও ছোট বাচ্চাদের সমস্যার কথা বললে তিনি বাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমি কয়েক মাস ফুলাত এসে থাকলাম এবং আমার স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কাজ করতে থাকি। তিন মাস পর আলহামদুলিল্লাহ! আমার স্ত্রীও মুসলমান হয়ে যায়।

প্রশ্ন : আপনার মা’র কী হলো?

উত্তর : আমি আমার মাকে মুসলমান হবার ব্যাপারে জানালে তিনি খুব খুশি হন এবং বলেন, তোর বাপের আত্মা এতে শান্তি পাবে। আমার মাও ঐ বছরেই মুসলমান হন।

প্রশ্ন : এখন আপনি কি করছেন?

উত্তর : বর্তমানে আমি একটি জুনিয়র হাইস্কুল চালাচ্ছি। স্কুলে ইসলামী শিক্ষার সাথে সাথে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে।

প্রশ্ন : আব্বা বলছিলেন, আপনি হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ বিভিন্না জায়গায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো পুনরায় চালু করার জন্য চেষ্টা করছেন?

উত্তর : ওমর ভাইয়ের সাথে মিলে আমরা ঠিক করেছি আল্লাহর ঘর ভেঙে আমরা যে বিরাট গুনাহ করেছি তার কাফ্ফারা হিসাবে আমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদগুলো চালু করব এবং নতুন নতুন মসজিদ বানাব। আমরা দু’জনে মিলে আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিব। আমি বন্ধ মসজিদগুলো চালু করব আর ওমর ভাই নতুন নতুন মসজিদ বানাতে চেষ্টা চালাবেন।

এ ব্যাপারে মসজিদ বানাবার ও সেগুলো লোকে ভরপুর করাবার কর্মসূচি হাতে নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! এ পর্যন্ত আমি হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি ও মিরাট সেনানিবাস এলাকায় ১৩টি বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদ পুনরায় চালু করেছি।

ওমর ভাই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত সে ২০টি মসজিদ তৈরি করেছে এবং একুশতম মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। আমরা উভয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবরি মসজিদ ভাঙার বার্ষিকীতে ৬ ডিসেম্বর তারিখে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদে অবশ্যই নামায শুরু করাতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আজ পর্যন্ত কোন বছরেই এটা করতে ব্যর্থ হইনি।

অবশ্য শ’য়ের লক্ষ্য পূরণ এখনও অনেক দূরে। আশা করছি এবছর এর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। আটটি মসজিদ সম্পর্কে কথাবর্তা চলছে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলো চালু হয়ে যাবে। ওমর ভাই অনেক আগেই তো লক্ষ্য অর্জনে আমার চেয়ে এগিয়ে আছে। আর আসলে আমার কাজও তো তারই ভাগে পড়ে। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার মাধ্যম তো মূলত সেই।

বাবরি মসজিদে প্রথম আঘাতকারী ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ : এর পেছনের ঘটনাটি জানলে অবাক হবেন!

প্রশ্ন : পাঠকদের জন্য আপনি কি কিছু বলবেন?

উত্তর : সকল মুসলমানের কাছে আমার একটিই নিবেদন আর তা হলো, নিজের জীবনের লক্ষ্য কী তা জেনে এবং ইসলামকে মানবতার আমানত মনে করে একে মানুষের কাছে পৌঁছে দিই, পৌঁছে দেবার কথা ভাবি।

কেবল ইসলামের প্রতি দুশমনীর কারণে তার থেকে বদলা নেবার প্রতিশোধ গ্রহণে উৎসাহিত না হই। আহমদ ভাই! আমি একথা একেবারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাবরী মসজিদ ভাঙায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিবসেনা, বজরং দলের সদস্যসহ সকল হিন্দু যদি এটা জানত যে, ইসলাম কী!

মুসলমান কাকে বলে? কুরআনুল করিম কী? মসজিদ আসলে কোনো বস্তুর নাম, তাহলে তাদের সবাই মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবতে পারত, মসজিদ ভাঙার প্রশ্নই উঠতো না।

আমি আমার প্রবল প্রত্যয় থেকে বলছি, বাল থ্যাকার, উইরে কুঠিয়ার যদি ইসলামের প্রকৃত সত্য ও মর্মবাণী জানতে পারে এবং জানতে পারে যে, ইসলাম (কেবল মুসলমানদের নয়) সবার ধর্ম, এটি আমাদের দরকার তাহলে তাদের প্রত্যেকেই নিজ খরচে বাবরী মসজিদ পূণর্বার নির্মাণ করাকে নিজেদের সৌভাগ্য ভাববে।

আহমদ ভাই! সে যাকগে, কিছু লোক তো এমন আছে যারা মুসলমানদের প্রতি শত্রুতায় বিখ্যাত, কিন্তু এখন এক শ’ কোটি হিন্দুর মধ্যে এমন এক লাখও হবে না। সত্য কথা বলতে কী,

আমি বোধহয় বাড়িয়ে বলছি, ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ লোক তো আমার বাবার মতো, যারা মানবতার বন্ধু এবং ইসলামী রীতিনীতি অন্তর দিয়েই পছন্দ করে। আহমদ ভাই!

আমার বাবা (কাঁদতে কাঁদতে) কী স্বভাবগতভাবে মুসলমান ছিলেন না? কিন্তু মুসলমানরা তাকে দাওয়াত না দেবার কারণে তিনি কুফরি অবস্থায় মারা গেছেন।

মাওলানা সাহেব সত্য বলেছেন, আমরা যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছি তারা না জানার কারনে এবং মুসলমানদের না চেনার কারণে এমন জুলুম করেছি। আমরা অজানা ও অজ্ঞতার দরুণ ও ধরনের জুলুম করেছি।

আমার পিতার কুফরি অবস্থায় মারা যাবার কথা যখন রাত্রে মনে হয় তখন আমার ঘুম পালিয়ে যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘুম আসে না। ঘুমের জন্য আমাকে ওষুধ খেতে হয়। হায়! মুসলমানদের যদি এই ব্যাথার অনুভূতি হতো! আল্লাহ হাফেজ।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ৩ জুন ২০১৮, ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • টেক

বিডিঅ্যাপস কানেক্ট: বিডিঅ্যাপস টপ ডেভেলপারস মিটআপ অনুষ্ঠিত

সম্প্রতি রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো বিডিঅ্যাপস কানেক্ট: এঙ্গেজ এন্ড ইনোভেট - টপ…

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:০৮ অপরাহ্ণ
  • অর্থনীতি

আগস্টে কমল মূল্যস্ফীতি

চলতি বছরের গত আগস্ট মাসে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:১৫ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্বপ্ন পূরণ করা হবে: ড. ইউনূস

জুলাই বিপ্লবে সকল শহীদে স্বপ্ন পূরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:০৭ অপরাহ্ণ