রাস্তায় পড়ে থাকা নবজাতক শিশুর জন্য একটি কুকুরের কান্না

হঠাৎ ফোন দিয়ে আমার বউ বলল, ‘আমার লাশ দাফন করতে আসিও’, এই বলে ফোনের লাইন বিছিন্ন করে দিল। বারবার ফোন করেও সাড়া নেই, বুঝতে পেরেছি অসুস্থতা বেড়ে গেছে, তাই আমি আর দেরি না করে বাড়িতে চলে আসলাম।

এসে দেখি যেমনটি ভেবেছিলাম ঠিক তাই। সময় ইফতারের পর সোমার সিএনজি যুগে হাজির হলাম কক্সবাজারের ঈদগাঁও মাতবর র্মাকেট ডা. মুজিবুর রহমানের চেম্বারে। সাথে ছিলেন আমার মা, বউ আর মেয়ে কায়রা।

রোগী দেখার পর ডাক্তার সাহেব কিছু টেস্ট দিলেন এবং রোগীকে সেলাইন টানিয়ে দিলেন। ভাবলাম সেলাইন শেষ হতে আর টেস্টের রিপোর্ট পেতে সময় লাগবে, মা যেহেতু রোগীর পাশে আছেন, সে ফাঁকে এক কাপ চা খেয়ে আসি, মাথার ওজনটা একটু হালকা করি।

নিচে এসে চা খেয়ে ফিরব, এমন সময় মামুন খলিফা নামে এক ব্যক্তির কাছে তিন বছর আগের এক লাখ টাকা পাই, সে কথাটা মনে পড়তেই আমি তার সাথে দেখা করতে তার দোকানের দিকে রওনা দিলাম। এসে তাকে পেলাম না। তার এক কর্মচারী বললেন, লুতু মিয়ার ঘাটার দিকে কোনো একটা কাজে গেছে মনে হয়।

মানুষের পিছু নেওয়া আমার কাছে খুব বিরক্ত মনে হয়, তাই ওইদিকে আর যাব না ভাবতে ভাবতে হাঁটা শুরু করেছি আবার ভাবলাম মাত্র এক মিনিট লাগবে, গেলেই মনে হয় ভালো হবে, তার ফোন বন্ধ।

আমি পা পা করে হাঁটা শুরু করলাম রাস্তার বাম পাশে দিয়ে। একটু অন্ধকার বৃষ্টিরজলে জলাবদ্ধ দেখে আরেকটু ভিতরে ঢুকে পরিত্যক্ত গাছের উপরে পা দিয়েছি মাত্র, হঠাৎ মনে হলো শিশুর কান্নার আওয়াজ।

আবার ভাবলাম, এত বড় বাজার, কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে, হয়তো কোনো মায়ের কোলের শিশু হবে! খেয়াল করলাম হাত দশেক দূরে একটা কুকুর বসে আছে। কুকুরের সাথে আমার চোখে চোখ পড়তেই কুকুরটি আমার দিকে দৌড়ে এলো এবং আমার চলাচলের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়াল।

একটু বলে রাখি, পৃথিবীতে দুইটা জন্তুকে আমি খুব বেশি ভয় পাই—একটা হচ্ছে সাপ আরেকটা কুকুর। বিশেষ করে কুকুরের ভয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে ফিরে গিয়ে অফিসে রাত কাটিয়েছি, এমন অনেক রাত আছে।

তবে আজকের ব্যাপরটা সম্পূর্ণ আলাদা। এই কুকুরটাকে কেন জানি আমি ভয় পাচ্ছি না, সেও আমাকে ভয় দেখাচ্ছে না। শুধু আমার রাস্তা আটকিয়ে নরম কণ্ঠে ঘেউ ঘেউ করে আমার চারপাশে ঘুরছে।

প্রায় পাঁচ মিনিট এই ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আবারও শুনতে পেলাম শিশুর কান্না, অবাক করার ব্যাপর হলো, শিশুটির কান্নার শব্দের সাথে সাথে কুকুরটি আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে এবং দশ হাতের মতো দূরে গিয়ে কুকুরটি আমার দিকে চেয়ে আকুতি কণ্ঠে আবারও ঘেউ ঘেউ করে কী যেন বলতে বা কিছু একটা বোঝাতে চাইছে।

আমি যে তার থেকেও বেশি অদম, সে কি আর জানে? আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

একসময় কৌশলে আমি দ্রুত পালিয়ে যাব, এমন সময় কুকুরটি দৌড়ে আবার আমার কাছে, আবার দৌড়ে আগের জায়গায়। এমনটি বেশ কয়েকবার করায় আমার মনে সন্দের জন্ম দেয়, হয়তো সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে ওখানে নিয়ে যাবার জন্য।

সব মিলে কুকুরের আহাজারি, অস্থিরতা দেখে আমি সামনে পা বাড়াতে দেখতে পেলাম একটা নবজাতক শিশু, কাপড়ে মোড়ানো মুখটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি মোবাইলের লাইট জ্বালিয়েছি এমন সময় শিশুটির কান্না বেড়ে গেল।

প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছি, পরে ভুল ভাঙলে চোখের পানিতে বুক ভেসে গেল। আমি নিশ্চিত হলাম কোনো হতভাগা নিষ্ঠুর নর-নারীর পাপের ফসল এই নিষ্পাপ শিশু। আগে এমন কতবার পত্রিকায় পড়েছি, কিন্তু বাস্তবাতা সীমাহীন কষ্টের এবং ভয়ের।

আমি নবজাতক শিশুটিকে কোলে তুলে নেব—এমন সময় কুকুরটি তার দু’পায়ে যেন মানুষের মতো হাত দিয়ে শিশুটিকে আমার কোলে তুলে দিতে অস্থির। সেটা যেন তার দায়িত্ব। আবেগ ভাসিয়ে অনুভব করলাম কুকুরটি কাঁদতেছে, আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।

শিশুটিক কোলে নিয়ে আশেপাশে কেউ আছে কি না জানতে চেষ্টা করলাম। না কেউ নেই। এই নবজাতক শিশুটির হয়তো আজ জন্ম নেওয়ার প্রথম দিন। তার কোনো অপরাধ নেই, তবুও সে অপরাধী।

স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টির শিল্পীরা যে কত নিষ্ঠুর সে হয়তো জানে না, যখন বড় হবে অযত্নে- অবহেলায় রাস্তায় রাস্তায়, তখন হয়তো আর সে জানতে পারবে না তার জন্মের ইতিহাস, হয়তো শুনবেও না। তার পরিচয় হবে রাস্তার মেয়ে, বাহ্ কত সুন্দর আমাদের মানবের নির্মমতা নীরব অবিচার।

শিশুটির মা হয়তো অনেক দয়াবান। এই জন্য দয়াবান বলছি, শিশুটিকে তো অন্তত জানে বাঁচিয়ে রেখেছে, হত্যা করেনি। সেটাও বা কম কিসে? মা-বাবা শিশুটির দায়িত্ব নিতে না পারলেও কুকুরটি ঠিকই তার দায়িত্ব নিয়েছে। সেও মানবতা বোঝে, বুঝি না শুধু আমরা মানুষ নামের দুই পাওয়ালা নরপুশুরা।

কুকুরটি শুধু শিশুটিকে পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা দেয়নি, খুঁজেছে শিশুটির জন্য নিরাপদ অভিভাবক, যে তাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবে।

কুকুরটি এত বেশি মানবিকতা জানে যে ঘটানাস্থলে শেষের দিকে সাহায্যকারী এক ভাইকে আমি পেয়েছিলাম। আমরা যখন শিশুটিকে ডাক্তার দেখাতে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি, কুকুরটিও আমাদের পিছে পিছে হসপিটালে চলে আসে।

ডাক্তার দেখানো শেষ করে বাইরে থাকিয়ে দেখি কুকুরটি হসপিটালের নিচে বসে আছে। তার এই মানবতা, আমার চোখের অানন্দ অশ্রু আর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল।

একটা কুকুর এতই মানবিক! তাকে আল্লাহ্ এত বেশি বুঝক্ষমতা দিয়েছে যে, আমরা মানব সৃষ্টির সেরা জাতি হয়েও একটা কুকুরের কাছে হেরে যাচ্ছি।

আমি নিচে এসে কুকুরটির জন্য পাউরুটি-কলা কিনে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম সে কিছুই খাচ্ছে না। কত ধরনের চেষ্টাই না করলাম কাজ কোনো হয়নি।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ৯ জুন ২০১৮, ৭:৪১ অপরাহ্ণ ৭:৪১ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • অর্থনীতি

আগস্টে কমল মূল্যস্ফীতি

চলতি বছরের গত আগস্ট মাসে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:১৫ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্বপ্ন পূরণ করা হবে: ড. ইউনূস

জুলাই বিপ্লবে সকল শহীদে স্বপ্ন পূরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:০৭ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

নতুন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন

রাষ্ট্রদূত মো. জসীম উদ্দিনকে নতুন পররাষ্ট্রসচিব করা হয়েছে। তিনি সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের স্থলাভিষিক্ত…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ