ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় অধ্যক্ষ ফেন্সিকে!

চাঁদপুরের কলেজের অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক যুবকের স্বীকারোক্তিতে মিলেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এমন দাবি করেই আজ বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন চাঁদপুর পুলিশ সুপার। পুলিশ বলছে, আইনজীবী জহিরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচনায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় ফেন্সিকে।

আদালতে জবানবন্দি দেওয়া যুবকের নাম রাকিবুল হাসান (২৩)। তিনি জহিরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমের চাচাতো ভাই ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তাঁকে গত রোববার ঢাকা থেকে আটক করা হয়। রাকিব জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে তাঁর সঙ্গে আরেক চাচাতো ভাই লিমনও অংশ নেন। তাঁদের উভয়ের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেহপুর পশ্চিম ইউনিয়নে।

রাকিব আদালতে কিলিং মিশনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, রাকিব তাঁর চাচাতো ভাই লিমনকে নিয়ে ঘটনার দিন (৪ জুন) ইফতারের পরপরই ফেন্সির বাসায় যান। বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে জহিরুল ইসলামের খোঁজ করেন এবং ফেন্সিকে বলেন, তাঁরা বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্র আইনজীবীকে দেখাতে এসেছেন। ফেন্সি তখন জহির বাসায় নেই বলার পরপরই রাকিব ও লিমন অত্যন্ত ভদ্রভাবে বাসার ওয়াশ রুম ব্যবহার করার অনুমতি চান। এ সময় তাঁদের একজন নিজেকে মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। তখন ফেন্সি তাঁদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে বলেন, ‘আমার মেয়েও ডাক্তার।’ ফেন্সি তাঁদের বলেন, তোমরা ইফতার করেছ? ডাইনিংয়ে খাবার আছে খেয়ে নাও।

রাকিবের ভাষ্যমতে, এ সময় তাঁরা দুজন টেবিলে বসে খেজুর খান। অন্যদিকে ফেন্সি তাঁদের আরও আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত থাকেন। এ সময়ই সুযোগ বুঝে তাঁদের একজন বাসার তালা দিয়ে পেছন থেকে ফেন্সির মাথার আঘাত করেন। এতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। এরপর দুজনে মিলে তালা দিয়ে একাধিক আঘাত শেষে বাসার ফল কাটার ছুরি দিয়ে মাথায় আরও কয়েকটি আঘাত করেন। তাঁরা ফেন্সির হত্যা নিশ্চিত করতে পলিথিন দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর রাকিব ও লিমন বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফেন্সির বাসা থেকে বের হয়ে লঞ্চঘাটে চলে যান।

রাকিব জবানবন্দিতে আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁর হাত কেটে যায়। লঞ্চঘাটে তা ব্যান্ডেজ করা হয়। পরে ওই রাতেই তাঁরা দুজন লঞ্চে করে ঢাকা যান। এরপর ঢাকা থেকে লিমন চাঁদপুর চলে এলেও রাকিব চলে যান গাজীপুর। পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডের পর রাকিব ও লিমন নিজেদের মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগ বন্ধ রাখেন। তবে তথ্যপ্রযুক্তির সূত্র ধরেই তাঁদের সন্দেহের তালিকায় রাখে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাই ফেন্সি হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। ঘটনার পর পুলিশ জুলেখার যে মোবাইল ফোন জব্দ করেছিল, তার কললিস্টে ঘটনার দিন রাকিব ও লিমনের সঙ্গে জুলেখার একাধিকবার কথা বলার প্রমাণ ছিল। এর সূত্র ধরেই গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাঁদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

জানা গেছে, ঘটনার দিন সকালে এই দুই যুবকের একজন ঢাকা থেকে আরেকজন মতলব উত্তর থেকে চাঁদপুর আসেন। এরপর তাঁরা শহরের হাসান আলী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে খুনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনামতো ইফতারের পরপরই কিলিং মিশনে অংশ নেন। তবে জবানবন্দিতে রাকিব জুলেখার কথা বললেও আইনজীবী জহির সম্পর্কে কিছু বলেছেন কি না, তা জানা যায়নি।

পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইনজীবী জহিরের সম্পৃক্ততা কতটুকু, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। হত্যার সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কি না, এর কোনো তথ্যও দেয়নি পুলিশ।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন বলেন, তদন্তের স্বার্থে অনেক কথাই বলা যাচ্ছে না। তবে মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। বাকি আসামিদেরও দ্রুত সময়ে আটক করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।

বুধবার বিকেলে চাঁদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার ওই প্রেস ব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ফেন্সি হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক ব্যক্তির জবানবন্দি নিয়েছি। এতে এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আইনজীবী জহির ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। আমরা চাই এর সঠিক তদন্ত শেষে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে।’ মঙ্গলবার বিকেলে রাকিবুল চাঁদপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ কায়সার মোহাম্মদ মোশারফ ইউছুফের আদালতে ১৬৪ ধারায় ওই জবানবন্দি দেন।

নিহত শাহিন সুলতানা ফেন্সি ফরিদগঞ্জের গল্লাক আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তাঁর স্বামী চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী জহিরুল ইসলাম। ঘটনার দিন রাতেই জহিরুলকে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাসহ শহরের নাজির পাড়ার ভাড়া বাসা থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ঘটনার পরদিন ৫ জুন ফেন্সির ভাই মো. ফোরকান উদ্দিন খান জহির ও জুলেখাসহ মোট চারজনের বিরুদ্ধে চাঁদপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। অপর দুই আসামি হচ্ছেন জহিরের ছোট ভাই নয়ন ও বোন রানু।

ঘটনার পর থেকেই নিহত ফেন্সির ভাইয়েরা ও মেয়েরা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য জহির ও জুলেখাকে দায়ী করে আসছেন। এ ঘটনায় তাঁরা সংবাদ সম্মেলনও করেন । তবে জহির আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

-প্রথম আলো

শেয়ার করুন: