আয়না

কিভাবে হল আয়না আবিস্কার? জানুন সেই ঘটনা

আয়না আবিস্কার: জাপানি রূপকথায় আছে, একদিন ভোরবেলায় সূর্যদেবতা নাকি কোনো কারণে খুব রেগে যান। রেগে গিয়ে তিনি নিজেকে এক গুহার মধ্যে লুকিয়ে ফেলেন। আর তখুনি সারা পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এলো।

পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদ, প্রাণী সূর্যের রাগ ভাঙাবার জন্য নানান চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কোনো ফল হল না। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে গুহার সামনে একটা চকচকে রূপোর আয়না ধরা হলো।

রুপোর আয়নায় নিজের রাগী-রাগী বিচ্ছিরি মুখখানা দেখে সূর্যদেব নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এটা সত্যিই তার মুখ কিনা।

ভালোভাবে নিজেকে দেখার জন্য আস্তে-আস্তে গুহার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন সূর্যদেব। আর যেই-না তিনি বাইরে এসেছেন অমনি গুহার মুখ সবাই মিলে পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিলো। সূর্যদেব আর ভেতরে ঢুকতে পারেন না। সেই থেকে সূর্য জাপানের আকাশে আজও রয়েছেন।

আয়না নিয়ে এরকম অনেক গল্পকথা ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে। ইংরেজ কবি ও লেখক জিওফ্রে চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’ গল্পমালায় আছে টারটারির রাজা কাম্বুস্কানের এমন একটা আয়না ছিল, সেই আয়না দেখে তিনি আগে থেকেই বলে দিতে পারতেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

‘রেনার্ড দ্য ফক্স’ রূপকথা সিরিজের প্রধান চরিত্র ‘রেনার্ড’ নামের শেয়ালটির কাছেও এমন একধরনের আয়না ছিল। এটা দিয়ে তিনি এক মাইল দূরের জিনিস দেখতে পেতেন।

আইরিশ সাহিত্যিক অলিভার গোল্ডস্মিথ তার গল্পে এক আশ্চর্য চীনা আয়নার কথা উল্লেখ করেছেন। এ আয়নার সাহায্যে যে কোনো মানুষের মন ও সেই মুহূর্তে সে কী ভাবছে তা বলে দেওয়া যায়।

আবার শোনা যায়, জাপানিরা দুস্কৃতকারীদের অপরাধের হদিশ পাওয়ার জন্য যখন জিজ্ঞাসাবাদ করতো তখন তাদের মুখের সামনে আয়না ধরতো। সত্যি কথা বা মিথ্যে কথা বলার সময় মুখের যে পরিবর্তন হতো তা তারা আয়নার মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করত।

নিজের মুখটা কীরকম দেখতে তা জানাই যেতো না যদি আয়নার আবিষ্কার না হতো। পানির মধ্যে নিজের ছায়া দেখে মানুষ প্রথম জানতে পারে সে কীরকম দেখতে। তারপর নানা চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তারা একদিন আয়না আবিষ্কার করে ফেলে।

জার্মান রসায়নবিদ জাস্টিস ভন লাইবিগ ১৮৩৫ সালে স্বচ্ছ কাঁচের এক পাশে টিন ও পারদের প্রলেপ দেওয়ার একটি কৌশল আবিস্কার করেন। এই কৌশলটিই ছিলো আয়না আবিষ্কারের মূল বিষয়।

পরে আরও বড় পরিসরে এবং বাণিজ্যিকভাবে আয়না উৎপাদনের জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজকের আধুনিক আয়নার রূপ আমরা দেখতে পাই।

পৃথিবীর সবচেয়ে যে পুরনো আয়নাটি সেটি পাওয়া যায় আনাতোলিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকে, এ জায়গাটি বর্তমান তুরস্কে। মিশর, মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) পর চীন দেশেও আদি আয়নার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।

অবশ্য উৎপত্তির শুরুতে আয়নার আদল বর্তমানের মতো ছিল না। স্বচ্ছ কাঁচের আয়নার ধারণা এসেছে আরও অনেক পরে। কাঁচের বদলে তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও রূপার চকচকে পৃষ্ঠকেই আয়না হিসেবে ব্যবহারের চল ছিল।

আয়নার ভেতর আলো প্রবেশ করলে আলোর চরিত্রে কী কী ধরনের পরিবর্তন আসে তা প্রাচীন গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিড সূত্রাকারে লিখে রাখেন। শোনা যায়, আর্কিমিডিস নাকি এ সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই অবতল আয়না তৈরি করেন।

রোমান রণতরী যখন সিরাকাস আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছিল তখন তিনি আয়নার ওপর সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে কোনো অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেন।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি ফারাসে লাইটহাউসের মাথায় একটা বিশাল আয়না লাগান যাতে শত্রুপক্ষের জাহাজকে এক মাইল দূর থেকে চেনা যায়।

১৬৬৮ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন টেলিস্কোপ তৈরি করেন। পৃথিবীর সব থেকে বড় ও নিখুঁত আয়না লাগানো আছে ক্যালিফোর্নিয়ার পালামোর পাহাড়ের মাথায় ২০০ ইঞ্চি হেল টেলিস্কোপের মধ্যে।

এর ওজন প্রায় সাড়ে চোদ্দ টন। আর সূক্ষ্মতা হলো দশ লাখ ভাগের এক ভাগ।এ টেলিস্কোপের মাধ্যমে অগণিত আরোকবর্ষ দূরে যেসব মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে তা জ্যোতিবিজ্ঞানীরা খুব সহজেই দেখতে পান।

শেয়ার করুন: