চার বছরের গাছে ৬০ কেজি সৌদি খেজুর!

“আগামী দশ বছরে খেজুর আমদানী বন্ধের স্বপ্ন গাজীপুরের নজরুলের” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর। প্রতিবেদনটিতে নজরুল ইসলামের খেজুর বাগানের সাথে সাথে দেশের মানুষের কাছে খেজুর চাষাবাদের নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল। প্রায় ২ বছর পর আবারো সেই নজরুল ইসলাম বাদলের খেজুর বাগান নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন।

প্রায় দুই বছর আগে যে বাগানটিতে দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল নজরুল ইসলাম বাদলের সাথে আজ সে খেজুর বাগানটি অনেকটাই পরিবর্তিত। বাগানের খেজুর গাছ গুলো যেমন বড় হয়েছে তেমনি গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে সৌদি জাতের খেজুর। আর এ দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানোটাই কঠিন। আর তাই বাগানে আসা লোকজনের চোখ যে অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে এমনটাই মনে হয়েছে কয়েকজন দর্শণার্থীকে দেখে।

নজরুল ইসলাম বাদলের সাথে আলাপের শুরুতেই ধন্যবাদ জানান প্রকাশিত ২০১৬ সালের প্রতিবেদনের জন্য। তিনি জানান, বাগানটির আজ যে পরিচিতি তা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে প্রথম প্রকাশিত প্রতিবেদনটির জন্য বাগানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে নজরুল ইসলাম বাদল জানান, তিনি তার আশার চেয়েও নিজেকে বেশি সফল বলে মনে করছেন। কারণ তার বাগানে বর্তমানে বিভিন্ন জাতের ১৫টি গাছে খেজুরের ফলন এসেছে। এবং অবাক করার বিষয়, তার বাগানে চার বছরের একটি গাছে ৬০ কেজির মতো খেজুর ধরেছে। এত ছোট গাছে এমন ফলন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি বলে জানান।

সেই সাথে গাছের বৃদ্ধি এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আগামী বছর আরো অনেক বেশি গাছে ফলন আসবে বলেও তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন, তার বাগানটি দেখতে এবং চারা ক্রয় করতে প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন আসছে। গত দুই বছরে তিনি ৬০ লক্ষ টাকার অধিক চারা বিক্রি করেছেন বলেও জানান। ২০১৪ সালের শেষের দিকে স্বল্প পরিসরে নিজের জমিতে নজরুল গড়ে তুলেছিলেন ছোট এ খেজুর বাগান। সৌদি থেকে বেশ দাম দিয়ে আমদানি করা চারা দিয়ে তার খেজুর বাগানের যাত্রা শুরু।

গত কয়েক বছরে যা আয়তনে বেড়েছে কয়েকগুন। বর্তমানে তার বাগানে ফলনের উপযোগী ১০০টির মতো খেজুর গাছ আছে। সেই সাথে ৪ হাজার চারা বপনের উপযোগী, যা পলি ব্যাগে লাগানো আছে। গত বছর কয়েকটি গাছে ফলন আসাতে নজরুল তার ২.৫ একর জমির পুরোটাই তৈরি করেছিলেন খেজুর চাষের জন্যে। আর চলতি বছরে ফলন দেখে তিনি আরো বেশি আশাবাদী।

বাজার সম্প্রাসারনের বিষয়ের জানতে চাওয়া হলে গত দুবছর আগে বাদল জানিয়েছিলেন, তার হাত দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাতে খেজুর গাছের বাগান সৃষ্টি হচ্ছে। যেসকল গাছ বপন করা হয়েছে তার বৃদ্ধিও ভাল। আর তাই তিনি ভাল ফলনের বিষয়েও আশাবাদী। তিনি আরো জানিয়েছিলেন সঠিক ভাবে পরিচর্যা করলে দেশের সকল জেলাতে নিয়ম নীতি মেনে খেজুরের বাগান গড়ে তোলা হলে ফলন আসবেই।

তার মতে বাংলাদেশের আবহাওয়া যে খেজুর চাষের জন্যে উপযোগী তা দেশী খেজুর গাছই প্রমান করে। আর সৌদি জাত গুলোকে একটু আলাদা ভাবে যত্ন নিলে ভাল ফলন আসে তা ইতি মধ্যে প্রমান করতে পেরেছেন তিনি। বাদলের মতে বাংলাদেশে যে মানের খেজুর আমরা পেয়ে থাকি তা সি গ্রেডের। আর এ গ্রেডের খেজুর যা আসে তার দাম অনেক বেশি। যা সাধারন ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে। তিনি বলেন বাংলাদেশে খেজুরের বিশাল বড় একটা বাজার রয়েছে । তিনি জানিয়েছিলেন যদি প্রতিটি জেলাতে পরিকল্পিত ভাবে বাগান গড়ে তোলা যায় তাহলে যে ফলন আসবে তাতে করে আগামী দশ বছর পর খেজুর আমাদানী হয়তো শূন্যের কোটায় চলে আসবে ।

দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতে তার বাগান থেকে চারা সরবরাহের বিষয়টি তুলে ধরে বাদল জানান, জেলার পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিও তার বাগান থেকে কয়েক হাজার চারা সংগ্রহ করে বাগান গড়ে তুলেছেন। চাহিদা মতো চারা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাকে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে। বর্তমানে চট্রগ্রামে বেশ কয়েকটি খেজুর বাগান গড়তে তিনি চারা সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে চাষীদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে জানান।

আজকের এ অবস্থানে আসার পিছনের দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে বাদল বলেন, অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। মানুষ অণেকটা তাচ্ছিল্যর চোখেই দেখেছিল শুরুর দিকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিত দেখে অনেকের কাছে আগ্রহের পাত্র আমি। তিনি বলেন, দেশের জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল “বিডিভিউ টোয়েন্টিফোর ডটকম” জাতীয় দৈনিক গুলো এবং বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে আমার খেজুর বাগান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যা আমাকে দেশ দেশের বাহিরে পরিচিতি এনে দিয়েছে।

বর্তমানে দেশের মানুষের কাছেও অনেকটাই পরিচিত নাম গাজীপুরের নজরুল ইসলাম বাদল। দীপ্ত কৃষিতে একাধিক বার নজরুলের খেজুর বাগানটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজ ঘুরে গেছেন নজরুলের বাগানটিতে। যে প্রতিবেদনটি হয়তো অচিরেই দেখা যাবে চ্যানেল আইয়ের পর্দায়।

বাগানের সফলতায় মুখে হাসি ফুটেছে বাদলের সহধর্মীনী তন্দ্রা ইসলামের মুখেও। উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করা তন্দ্রা নিজ মুখেই সত্যটা স্বীকার করে জানান, প্রথমে যে ব্যবসাটি ছিল তাদের সেটি বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়লে তিনি মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েন। তার পর আবার সৌদি জাতের খেজুর বাগান করার বিষয়টি সামনে আসলে তিনি পুরোপরি দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে তিনি খেজুর বাগান করার বিষয়ে স্বামীর সাথে একমত ছিলেন না। তবে বর্তমানের সফলতার মুখ দেখতে পেরে প্রতিবেদকের সাথে আশাবাদী কন্ঠে তন্দ্রা বলেন, নজরুল ইসলাম বাদল আজ দেশ বিদেশে পরিচিত মুখ।

বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব প্রায়ই তাদের বাগান দেখতে আসেন। তাছাড়া দেশের জনপ্রিয় প্রতিটি দৈনিকে তাদের খেজুর বাগানটিকে নিয়ে লিখা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে বাদলের সফলতার গল্প। তিনি জানান, বাদলের পাশে থেকে সহযোগিতা করে যেতে চান। এবং ভবিষৎতে এর পাশাপাশি অন্য কিছু করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়েও কথা বলেন তিনি।

নজরুল ইসলাম বাদলের বাবা ডা: জিল্লুর রহমান বলেন, ছাত্র জীবনে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন নজরুল ইসলাম। বিভিন্ন কারণে সন্তানকে সঠিক জায়গাতে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারার ব্যর্থতা নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়িকভাবে যখন বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েন বাদল তখন সে অবস্থান থেকে ছেলেকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছেন বাবা জিল্লুর রহমান।

ছেলে খেজুর বাগান করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে তখনও ছেলেকে নিরাশ না করে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন জিল্লুর রহমান। এক সময় তিনি স্বপ্ন দেখতেন ছেলে বড় হয়ে বড় কিছু করবে। তিনি আজ নজরুলের সফলতা দেখে অনেক বেশি আশাবাদী। নজরুল ইসলাম বাদলের শুশুড় একে এম নজরুল ইসলাম জানান, চাকরীর চেয়ে ব্যবসা ভাল আর তাই ব্যবসায়ী ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। যখন মেয়েকে বিয়ে দেই তখন বাদল মোবাইল ফোনের ব্যবসা করতেন।

আর বর্তমানে সে একজন সফল খেজুর বাগানের মালিক। মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীর কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর সে ব্যবসা বন্ধ করে খেজুর বাগান করার বিষয়টি তার কাছে কেমন লেগেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে বলে প্রথম থেকেই ভাল লাগছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি হতাশ হননি বলেও জানান। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি ড. এনামুল হ জানান, নজরুল ইসলামের বাগানটি পছন্দনীয়। গাছের বৃদ্ধি এবং ফলনকে তিনি স্বাভাবিক চোখেই দেখছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়াতে খেজুর চাষাবাদ সম্ভব। যারা খেজুর চাষাবাদের বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী তারা সঠিক নিয়ম মেনে বাগান করলে শতভাগ সফল হবেন বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে স্থানীয়রাবলেন, নজরুলের খেজুর বাগানটি নিয়ে বর্তমানে তারাও বেশ আশাবাদী। এ বছর ভাল ফলন আসাতে তারা নিজেরা আগ্রহ প্রকাশ করেন খেজুর বাগান গড়তে।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ১৭ জুলাই ২০১৮, ৪:৫২ অপরাহ্ণ ৪:৫২ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • অর্থনীতি

আগস্টে কমল মূল্যস্ফীতি

চলতি বছরের গত আগস্ট মাসে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:১৫ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্বপ্ন পূরণ করা হবে: ড. ইউনূস

জুলাই বিপ্লবে সকল শহীদে স্বপ্ন পূরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:০৭ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

নতুন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন

রাষ্ট্রদূত মো. জসীম উদ্দিনকে নতুন পররাষ্ট্রসচিব করা হয়েছে। তিনি সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের স্থলাভিষিক্ত…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ