আশরাফুল

এবার বন্ধু আশরাফুলকে অন্যরকম সহযোগিতা মাশরাফির

আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা : ক্রিকেটার, পারফরমার, অধিনায়ক আর মানুষ মাশরাফির মত বন্ধু মাশরাফিও কিন্তু অনেক বড়। বন্ধু বাৎসল্য তার চরিত্রের একটি বড় দিক।

এতবড় ক্রিকেটার, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা তারপরও ঢাকায় এবং নড়াইলে অবসরে বন্ধুদের সঙ্গেই কাটে তার সময়। সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল প্রয়াত ক্রিকেটার বন্ধু মাঞ্জারুল ইসলাম রানা, আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ রাসেলদের হরিহর আত্মা মাশরাফি। রানার জন্য এখনো মন কাঁদে তার।

অন্য সমসাময়িক ও বন্ধুপ্রতিম ক্রিকেটারদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতেও জুড়ি নেই মাশরাফির। ব্যক্তি জীবনে প্রাণ খোলা স্বভাবের। হৈ চৈ পছন্দ। কিন্তু বন্ধুদের প্রয়োজনে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন নিরবে-নিভৃতে।

কোন বন্ধুর ইনজুরি? কিংবা হঠাৎ একটা বড় অংকের অর্থ প্রয়োজন- মাশরাফি আগ বাড়িয়ে তাকে সাহায্য করেন। তার অন্য খবর চাওর হলেও এসব মানবিক গুণ এবং বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানোর খবর অনেকটাই ঢাকা থাকে।

পরিচিত সংবাদকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপে বার বার বলেন, প্লিজ ভাই এসব লিখবেন না। মানুষ মানুষের জন্য। এক বন্ধুর প্রয়োজনে, দরকারে আরেক বন্ধু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে, এগিয়ে আসবে, পাশে দাঁড়াবে এটাই তো বন্ধুত্ব। এরই নাম মানবিকতা। তা নিয়ে ঢোল পেটানোর কি আছে?

এই তো গত বছর প্রিমিয়ার লিগে ছেলেবেলার বন্ধু জাতীয় ক্রিকেটার সৈয়দ রাসেলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মাশরাফি। বাঁ-হাতি পেসার রাসেলের ইনজুরি মুক্ত হতে দরকার ছিল মোটা অংকের অর্থের।

মাশরাফি বিনা শর্তে কখনো শোধ না করার শর্তে সৈয়দ রাসেলকে চার লাখ টাকা দিয়ে দেন। বন্ধু মাশরাফির এমন বদান্যতা, আন্তরিকতার কথা সৈয়দ রাসেলের উদ্ধৃতি দিয়ে ফলাও করে প্রকাশও হয়েছিল।

মাশরাফি অবশ্য তাতে খুশি হননি। বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই তুই আবার ….. ভাইকে ওসব বলতে গেলি ক্যান ? এই হলো মানুষ, ক্রিকেটার, অধিনায়ক ও বন্ধু মাশরাফি।

এখানেই শেষ নয়। নড়াইল এক্সপ্রেসের বন্ধু প্রীতি ও আন্তরিকতার এক নতুন গল্প আছে । শুনুন মন দিয়ে। এবার ক্রিকেটার বন্ধু মোহাম্মদ আশরাফুলের পাশে মাশরাফি।

জেনে অবাক হবেন, আশরাফুলের এবারের লিগে দারুণ খেলা, তিন সেঞ্চুরি হাকিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়ার পিছনেও মাশরাফি! একটু অবাক হচ্ছেন তাই না? মাশরাফি খেলেন, আবাহনীতে। আর আশরাফুল কলবাগানে। দু’জন এক দলে থাকলে না হয় বলা যেত, মাশরাফির অনুপ্রেরণা আর নিরন্তর উৎসাহেই এত ভালো খেলেছেন আশরাফুল।

ভিন্ন দলে খেললেই যে বন্ধুকে অনুপ্রাণিত করা যাবে না, তাকে বুদ্ধি, পরামর্শ ও উৎসাহ দেয়া যাবে না, এমন নয়। যায়। সেটা মাশরাফি একা নন, আশরাফুলের সুহৃৎ ও শুভানুধ্যায়ী কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীসহ আরও অনেকেই দিয়েছেন।

কিন্তু জানেন, আসল কাজটি করেছেন মাশরাফি। আশরাফুলকে ফিটনেস সচেতন করে তুলে আগে ফিটনেসে মনোযোগি হওয়া, ওজন কমানো এবং শরীরটাকে চাঙ্গা রাখার পরামর্শ দিয়ে প্রকারন্তরে আশরাফুলের ব্যাটকেই সচল করে দিয়েছেন মাশরাফি।

হাওয়া থেকে পাওয়া খবর নয়। ক্রিকেট পাড়া কিংবা শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের আশেপাশের গুঞ্জন নয়। আশরাফুলের নিজের মুখের কথা। বুধবার রাতে
আলাপে আশরাফুলই শোনালেন বন্ধু মাশরাফি এবার তার কেমন উপকার করেছেন। আশরাফুলের ভাষায়, আমার এবার ভালো খেলার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা মাশরাফির।

কেন কর্মকর্তা, কোচ জালাল চৌধুরী, বন্ধু-বান্ধব ও সুহৃৎ-শুভানুধ্যায়ীরা কি অনুপ্রেরণা জোগাননি? আপনাকে ভালো খেলতে, আবার ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে তারাও কি অনুপ্রেরণা জোগাননি? আশরাফুলের বিনম্র জবাব, অবশ্যই।

সবাই উৎসাহ জুগিয়েছেন। কোচ জালাল স্যার আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। ভালো খেলার কৌশলও বাতলে দিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি মন থেকে সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিবো মাশরাফিকে।

আমার এবার লিগে ভালো খেলা তথা রান করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বন্ধু মাশরাফির। আমি চরম কৃতজ্ঞ বন্ধু মাশরাফির কাছে। আমার মনে হয় আসল কাজটি করে দিয়েছে বন্ধু মাশরাফি। তার কারণে, আমার ব্যাট থেকে শেষ অবধী তিন সেঞ্চুরি বেড়িয়ে এসেছে। আমি রানে ফিরেছি।’

তার আগে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার মাশরাফি আর আশরাফুল কেমন বন্ধু ? কত দিনের সম্পর্ক। বর্তমান প্রজন্মের হয়তো অনেকেরই জানা নেই, মাশরাফি, নাফিস ইকবাল ( আকরাম খানের ভাইপো, তামিম ইকবালের বড় ভাই), আশরাফুল আর আফতাব এক ব্যাচের।

সেই অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে এক সঙ্গে খেলে বড় হয়েছেন। তারপর যুব দলেও (অনূর্ধ্ব-১৯) খেলেছেন একত্রে। বন্ধুত্বটা আসলে তখন থেকেই।

আশরাফুল ম্যাচ গড়াপেটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় বন্ধু মাশরাফিই সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন। প্রিয় ক্রিকেটার বন্ধুর অনৈতিক পথে হাঁটা একদমই পছন্দ হয়নি। তাই প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। মাঝে হাই-হ্যালো ছাড়া কথাও বলতেন না তেমন।

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আশরাফুল মাঠে ফেরায় এখন মাঝে মধ্যে কথা হয় দুইজনের। তবে সেটাও নিয়মিত নয়। কালেভদ্রে। তাই আশরাফুলের কাছে জানতে চাওয়া, বন্ধু মাশরাফির সঙ্গে তো আপনার দেখাই হয় না, হলেও হঠাৎ। তাই সে আপনার ভালো খেলার পেছনে অত বড় ভূমিকা রাখলো কিভাবে?

আশরাফুল আবেগতাড়িৎ হয়ে বলে উঠলেন, শুনবেন সে গল্প? তাহলে শুনুন, এই বলে আশরাফুল শুরু করলেন, বন্ধু মাশরাফির উপকারের গল্প। যার পরতে পরতে আন্তরিকতার পরশ।

আসুন বাকিটা না হয় আশরাফুলের মুখ থেকেই শোনা যাক, আমার দল কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে খেলাঘর সমাজ কল্যানের ম্যাচ ছিল শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। আমি সে ম্যাচে জিরো করে আউট হয়ে গেছি। আউট হবার ধরনটা ছিল খুবই খারাপ।

আমার ক্যারিয়ারে কখনো অত বাজে বলে আউট হয়েছি কি না মনে করতে পারছি না। লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ পড়ে আরও বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া এক আলগা ধরনের ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে আউট। মনটা খুব খারাপ। গোমড়া মুখে বসেছিলাম। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিল না একটুও। হঠাৎ দেখি আমার ড্রেসিং রুমে মাশরাফি এসেছে।

কাছে এসে সৌজন্যতা বিনিময়ের পর বললো কিরে, তোর এই দুর্দশা কেন? কি বাজে বলে এমন শ্রীহীন শট খেলে আউট হলি। আমি বললাম, হ্যা দোস্ত মনটা তাই খারাপ। মাশরাফি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো মন খারাপ করে বসে থাকবি, নাকি আবার রানে ফিরতে চাস? আর কি ভালো খেলার ইচ্ছে নেই ?

আমি বললাম অবশ্যই আছে। আবার নিজেকে মেলে ধরতে চাই বলেই প্রিমিয়ার লিগ খেলছি। কিন্তু রান পাচ্ছি না। যদিও একটি সেঞ্চুরি করেছি। কিন্তু ব্যাটিং করে ভালো লাগছে না।

পর পর দুই খেলায় ০ রানে আউট হয়ে গেছি। কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে। তাই ভাবছি সমস্যা কোথায়? টেকনিক আর স্কিলে বড় ধরনের কিছু হলো কি না? আমি কি ব্যাটিং টেকনিক ভুলে গেলাম? আমার স্কিল ফুরিয়ে গেল নাকি?

মাশরাফি অভয় দিয়ে বললো, ‘ আরে নাহ, টেকনিক আর স্কিল নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। তোর মত টেকনিক আর স্কিল কয়জনার আছে। টেকিনিক আর স্কিল নিয়ে অত মাথা ঘামাস না। ওসব নিয়ে অত চিন্তারও কিছু নেই। সেটা ঠিকই আছে।

শোন, একটা কথা বলি। তোর ফিটনেস সমস্যা। ওজন বেড়ে গেছে মুটিয়ে গেছিস। শরীর ভারী হওয়ায় বডি ও ফুট ম্যুভমেন্টও স্লো হয়ে গেছে। বলের পেছনে শরীর ও পা যাচ্ছে না ঠিকমত। আর শরীর স্লথ হওয়ায় শট খেলার জন্য যে ক্ষিপ্রতা ও চপলতা দরকার সেটাও হ্রাস পেয়েছে।

তাই শট পারফেক্ট হচ্ছে না। শটে পাওয়ার আসছে না। সবার আগে তাই আগে ওজন কমা। ফিটনেস বাড়া। নিজেকে ফিজিক্যালি শতভাগ ফিট কর, দেখবি অনেক ঝড়ঝড়ে লাগছে। চপলতা-ক্ষিপ্রতা বেড়ে যাবে, শটস খেলতে পারবি আগের মত।’

মাশরাফির কথাগুলো অমার ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগালো। ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেললো। মনে হলো তাই তো। আসল সমস্যা তাহলে শরীরে। ব্যাস বন্ধুর পরামর্শ মেনে মন দিলাম ওজন কমাতে। ফিটনেস বাড়াতে।

সেই রাত থেকে ভাত বন্ধ। শরীর হালকা করতে শর্করা খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে নতুন খাদ্য তালিকা তৈরি করলাম। বিশ্বাস করুন মাশরাফির সঙ্গে কথা বলার পর থেকে আজ অবধী এক বেলাও ভাত খাইনি। ফিটিনেস ট্রেনিংও বাড়িয়ে দিয়েছি। শরীর সতেজ ও ঝড়ঝড়ে লাগছে অনেক।

আর শরীর হালকা হবার প্রভাবে ব্যাটেও রানের ধারা ফিরে এসেছি। যে আমি প্রথম পাঁচ ম্যাচে ( ২৫+১০৪+৮+০+০ ) করেছিলাম মাত্র ১৩৭। সেই আমি মাশরাফির কথা মেনে ফিটনেস সচেতন হয়ে পরের ছয় খেলায় দুই সেঞ্চুরি ( ১০২*+ ০+ ৬৪+ ১৬+ ১২৭ ) আর এক হাফ সেঞ্চুরিতে করলাম প্রায় তিন গুণ ৩০৯ রান ।

সত্যিই মাশরাফি প্রকৃত বন্ধুর কাজ করেছে। কাউকে না জানিয়ে আমাদের কলাবাগানের ড্রেসিং রুমে অন্তত এক থেকে দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলে গেল। শুধু ধন্যবাদ যথেষ্ঠ নয়। বন্ধু মাশরাফির পরামর্শ আমাকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান।’

দেখলেন তো মাশরাফির বন্ধু বাৎসল্য। মাশরাফিকে খুব কাছ থেকে চেনেন, জানেন তাদের কেউ কেউ হয়তো বলবেন আরে নাহ, আশরাফুল অন্ধকার পথে পা বাড়ানোর পরতো মাশরাফি রাগে, ক্ষোভে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। প্রকশ্যে তার সমালোচনাও করেছে।

বলেছে আশরাফুলের প্রতি আমার কোন ভালোবাসা আর দুর্বলতা নেই। সেই মাশরাফি আশরাফুলকে রানে ফেরার পরামর্শ দিতে যাবে কোন দুঃখে?

কেউ এমন মন্তব্য করতেই পারেন। সেটা মিথ্যে নয় একচুল। সত্যিই তাই। প্রিয় বন্ধু ও প্রিয় ব্যাটসম্যান আশরাফুল ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত হবার পর মাশরাফি একদমই তা মানতে পারেননি।

মনে আশরাফুলের জন্য একটা ঘৃণাও জন্ম নিয়েছিল। সময়ের প্রবাহতায় সে ঘৃণার প্রকাশ গেছে কমে। তার বদলে এসেছে সহানুভূতি। মনে হয়েছে, আরে ছেলেটা আবার রানে ফেরার সংগ্রাম করছে, দেখি একটা সৎ পরামর্শ দিয়ে।

মাশরাফি আবার আশরাফুলের পাশে, সহানুভূতির পরশ নিয়ে, এটা যারা বিশ্বাস করতে কম চাইবেন, তাদের জন্য শুধু একটাই কথা, মানুষ আর বন্ধু মাশরাফি যে অনেক উদার। অনেক বড়। সে কারনেই বন্ধু বৎসল মাশরাফি আবার যেচে আশরাফুলের পাশে। তাকে রানে ফেরাতে সু-পরামর্শ দেয়া। এখানেই মাশরাফি অন্যদের চেয়ে আলাদা।

শেয়ার করুন: