রেসিপি

‘৫৬ হাজার বর্গ মাইলই আমার স্বামীর কবর’

আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি :

একটি সবুজ শ্যাওলা ভাসা পুকুর। সে পুকুরে ভাসছে একটি শূন্য নৌকা। পরের দৃশ্য জলের উপর আকাশের প্রতিবিম্ব। এই দৃশ্যের ভেতর দিয়ে মহা শূন্যতার মাঝে হাহাকারের ইঙ্গিত রেখে শুরু হয় টেলিছবি ‘আয়েশা’।

১১ বছর পর টেলিভিশনে ফিরে নন্দিত নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী এমন দৃশ্য দিয়ে শুরু করেন এবং যার শেষটা হয় এক নারী মুখের চোখে ঝুলতে থাকা দুফোটা জলের মাধ্যমে।

ভাইব্রাদার এক্সপ্রেস সিরিজের মধ্য দিয়ে ঈদ উপলক্ষে নিজের নির্মাণ নিয়ে হাজির হয়েছেন এই সময়ের নন্দিত নির্মাতা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী। আর তার বদৌলতে টেলিভিশনের পর্দায় আমরা ভিন্ন স্বাধের এক কাজ পেলাম। যেন দূর থেকে বিস্তির্ণ হাওরের জলে ভেসে আসছে কোনো এক নারীর হাহাকার। যাকে আমরা চিনি আবার ঠিক চিনি না।

অথচ তার কন্ঠস্বর আর্তনাদ কত যে চেনা আমাদের...। আয়েশা সেই হাহাকার জাগানিয়া এক গল্প। যে গল্পটি কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক লিখেছেন ‘কলমে কালিতে’ আর মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী তাকে তুলে আনলেন ক্যামেরায়। ফ্রেমে ফ্রেমে আমরা দেখলাম এক বেদনা বিধুর দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

টেলছবিটি ঈদের ২য়দিন প্রচার হয় চ্যানেল আইতে। এরপর সেটা চ্যানেল আইর ইউটেউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। আয়েশা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। আর জয়নাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী।

যে ক্যানভাস আমরা দেখেছি টিভি স্ক্রিণে তা ৪১ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু যে দুঃখ যে বেদনার ক্ষত আমরা টের পেয়েছি ভেতরের সে ক্ষত গতকালকের, সে ক্ষত আজকের মতো কাচা। ১৯৭৭ সালের গল্প।

কিন্তু যা এই বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষতকেও নাড়া দিয়ে যাবে। সে কথায় একটু পরে আসি। তার আগে ফেরা যাক গল্পের কাছে। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক ১৯৭৭ সালের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছিলেন ‘আয়েশা মঙ্গল’ উপন্যাস। সেই গল্প অবলম্বনেই মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর চিত্রনাট্য তৈরি করে নির্মাণ করেছেন ‘আয়েশা’।

ফ্রেমে ফ্রেমে সাজানো গল্পে টিভি বাক্সে সিনেমা দেখার স্বাদ দিবে অনায়াশে। যদিও বিজ্ঞাপনের কারণে সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন দর্শকরা। এ ক্ষেত্রে আমার মতো ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন পুরো গল্পটি এক সাথে।

গল্পের শুরুতেই দেখা যায় বিমান বাহিনীতে কর্মরত তরুণ জয়নাল বিয়ে করেন গ্রামের মেয়ে আয়েশাকে। গ্রামে থাকলেও আয়েশা শিক্ষায়, সমাজ দর্শন মানবিক গুনাবলির এক অনন্য রুপ।

ছবিতে খুব অল্প কথাতেই উঠে আসে প্রেম ভালোবাসার রসায়নের কথা। নতুন সংসারে আয়েশা যখন স্বামীর সাথে শুয়ে গল্প করছে তখন তাকে বলতে শোনা যায়-

‘স্বামী স্ত্রী হইলো গাছের মতো। দুইটা গাছ উপর থেকে আলাদা দেখালেও শেকড়ে শেকড়ে তাদের যোগাযোগ আছে। এক শিকড় আরেক শিকরকে খাওন দেয়, দুজন ঝগড়া করে, ভালোবাসে, ভাবের আদান প্রদান করে। স্বামী স্ত্রী হচ্ছে সেই রকম। মনের মিল থাকলে শেকড়ে শেকড়ে সব জানা জানি হয়ে যায়।’

চিড়িয়াখানায় গিয়ে আয়শার মন খারাপ হয়। আয়েশা মনে করে প্রকৃতি হবে মুক্ত। অবরুদ্ধ না। অথচ চিড়িয়াখানায় সব বন্দি জীবন। আয়েশা মন খারাপ করে স্বামী জয়নালকে বলেন,

‘চিড়িয়াখানায় এসে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আজীবন দেইখা আসছি পশু পাখি থাকে প্রকৃতির কাছে খোলা আকাশের নিচে, আর এইখানে কি দেখতাছি? সব পশুপাখিরে খাচার ভেতর ভইরা রাখছে।’

এই মানবিক গুণ প্রেম ভালোবাসার আয়েশার জীবনে এলো অন্য এক সময়। জীবন আয়েশাকে দাঁড় করালো রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর পাঠশালার সামনে। আয়েশা গ্রামে পরিবারের কাছে যে জীবনের পাঠ নিয়ে বড় হয়েছিলো রাষ্ট্র তাকে এবার ভিন্ন পাঠ দেয়। সেই পাঠ যাত্রারই দুঃখ জাগানিয়া গল্প আয়েশা।

এক রাতে জয়নালের ডাক আসে। জয়নাল বের হয়ে যায়। এরপর আর খবর নেই! ক্যূ এর অভিযোগে জয়নালকে আটক করে রাখা হয়। অথচ তার আগেই জয়নাল বলেছিলো তার স্ত্রী আয়েশাকে যে, সে এর সাথে জড়িত না। সে তার চীফকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু উল্টো তাকেই আটকে রাখা হয়। এদিকে আয়েশা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। কোন খোঁজ নেই।

চিন্তিত আয়েশা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কপাট সরে যায় মৃদু বাতাসে। আমরা দেখি কালো শিকের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আয়েশা। বাতাসে শুকাতে দেয়া শাড়ি নড়ছে। হঠাৎ কেঁদে ফেলে আয়েশা। চাপা কান্না। দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে কাঁদছে। এই কান্না সে কাঁদতে চাচ্ছে না। কিন্তু দুশ্চিন্তা অসহায়ত্ব তাকে কাঁদিয়েই চলছে।

আমরা দেখি গল্পের ভেতর স্ত্রী আয়েশার এক অসহায় চিত্র। যে চিড়িয়াখানার পশু পাখির বন্দি জীবন দেখে মন খারাপ করে সেই মেয়ের সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসার মানুষটি বন্দি হয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আর অসহায়ের মতো দাড়ে দাড়ে ঘুরছে অথচ কিছুই করতে পারছে না। এমন এক নারীর মনস্তত্বে কি ধরনের যন্ত্রণার নীল বিষ ঢুকে গেছে তা বুঝা যায় দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখে।

গর্ভে সন্তান নিয়ে বাধ্য হয়ে আয়েশাকে গ্রামে ফিরতে হয়। যখন স্বামীর কোনো ধরনের খবর পাচ্ছিলো না তখন আয়েশার পিতা তাকে একটা আয়না এনে দেয়। আধ্যাত্বিকতায় বিশ্বাস থেকে সে ওই আয়না এনেছে।

তার বিশ্বাস ওই অায়নায় অলৌকিকভাবে হারানো মানুষের খবর পাওয়া যায়। শিক্ষিত আয়েশা সে আয়না লুফে নেয়। সে তার স্বামীর খোঁজ জানতে চায় ওই আয়নায়।

ওই দৃশ্যটিই বলে দেয় মানুষের সামনে যখন আর কোনো পথ খোলা থাকেনা তখন সে ম্যাজিকাল কোনো কিছুর আশায় বসে থাকে। তখন সে অলৌকিক গল্পকেই আকড়ে ধরতে চায় অসহায় বাস্তবতায়। রাষ্ট্র আয়শাকে সেই অলৌকিক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।

আয়শা আয়নার কাছ থেকে যে উত্তর পায় সেটা কি আদৌ সত্য না মিথ্যা তাতো যাচাইয়ের আর কোনো উপায় নেই। তবুও আয়েশা অপেক্ষা করে। তার জীবনের নতুন মিরাকলের জন্য অপেক্ষা, কোনো ম্যাজিক যদি ঘটে যায়, যদি জয়নাল এসে ডাক দেয়- আয়েশা ও আয়েশা....।

এক সময় ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে এক কর্মকর্তাকে আয়েশাকে বলে, ‘জীবিত মানুষটারে দেখতে চাইলাম, দিলেন না। মৃত মানুষটারেও দেখতে দিলেন না। কবর কোথায় সেটাও বলতেছেন না। আমরা কবর জিয়ারতও করতে পারবো না? এটা কোন বিচার, স্যার?’

এরপর সে গ্রামের ফেরার পথে একটি অচেনা পথে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করে। তখন তার আত্মীয়র প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমিতো জানিনা আমার স্বামীর কবর কই? আমার কাছে এই ৫৬ হাজার বর্গ মাইলই স্বামীর কবর।’

নিখোঁজ স্বজনের কাছে এই দীর্ঘ শ্বাসের পর আর কোনো কথা থাকে না। আর কোনো কথার প্রয়োজন হয় না। এই স্বাধীন বাংলাদেশে সেই জন্মলগ্ন থেকেই এমন হাজার হাজার গল্প সৃষ্টি হচ্ছে।

এখনো... পত্রিকার পাতায়, ভুক্তভোগির আহাজারী আর্তনাদের কাঁন্নাগুলো এখনো শোনা যায়। নানাভাবে নানারুপে নানা নামে। কত না অভিযোগে কিংবা ভুলে মানুষ গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

রাজনীতির ক্ষমতার পালা বদল হয়। এক হাত থেকে আরেক হাতে যায় ক্ষমতা। এক নাম থেকে আরেক নাম...। কিন্তু এই চাপা আর্তনাদের গল্পগুলো সেই একই রকম আছে।

স্বজনের অসহায়ত্বের পরিবর্তন নেই। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠার সেই শব্দ, সেই রাতের ডাক, সেই ফিরে না আসা, সেই নিখোঁজ হয়ে থাকার গল্পগুলো একই রকম আছে...। কান পাতলেই শোনা যায় সেই সব হাহাকার...। কারো কারো কাছে এখনো ৫৬ হাজার বর্গমাইলইতো একটা কবর...।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ২৫ আগস্ট ২০১৮, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • টেক

বিডিঅ্যাপস কানেক্ট: বিডিঅ্যাপস টপ ডেভেলপারস মিটআপ অনুষ্ঠিত

সম্প্রতি রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো বিডিঅ্যাপস কানেক্ট: এঙ্গেজ এন্ড ইনোভেট - টপ…

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:০৮ অপরাহ্ণ
  • অর্থনীতি

আগস্টে কমল মূল্যস্ফীতি

চলতি বছরের গত আগস্ট মাসে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:১৫ অপরাহ্ণ
  • জাতীয়

জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্বপ্ন পূরণ করা হবে: ড. ইউনূস

জুলাই বিপ্লবে সকল শহীদে স্বপ্ন পূরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.…

৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:০৭ অপরাহ্ণ