কাকু ডাক্তার আমাদের মাথা কেটে দেবে!

যমজ সন্তান জন্ম গ্রহণের পরে উৎসাহ-আগ্রহের কমতি থাকেনা স্বজন ও প্রতিবেশিদের। কিন্তু সেই শিশু জোড়া মাথার যমজ শিশু হওয়ায় সেখানে আনন্দ কিংবা আগ্রহের পরিবর্তে নিরানন্দে পরিণত হয় পরিবারটির মধ্যে।

গত প্রায় আড়াই বছর আগে পাবনার চাটমোহরে এক শিক্ষক দম্পতির সংসারে জন্ম নেয় জোড়া মাথার যমজ কন্যা শিশু। ঘরে নতুন অতিথি আসলেও স্বজন-প্রতিবেশিদের মাঝে নেই আনন্দ।

জন্মের পর থেকে দিন যত যায় দুশ্চিন্তা ততই ভর করে সবার মনে। পরিবারসহ আশপাশের সবার একটাই চিন্তা কিভাবে এই শিশু দুটি আলাদা হবে। কোথায় এর সঠিক চিকিৎসা মিলবে।

গত বছর থেকে শিশু দুটিকে নিয়ে লাগাতার ভাবে সচিত্র প্রতিবেদন দেশের বিভিন্ন ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার শুরু করলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিষয়টি নজরে আসে। এরপর থেকে শিশু রাবেয়া রোকাইয়াকে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

সেখানে বার্ণ ইউনিটে তাদের সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। বিদেশ থেকেও এই শিশু দুটির চিকিৎসার ব্যাপারে আনা হয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরিক্ষা। সেটা এখন পর্যন্ত চলছে বলে পরিবারটির পক্ষ থেকে জানা গেছে।

সর্বশেষ গত মাসের ১৪ তারিখে শিশু দুটিকে পরীক্ষা নিরিক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। চলে নানা ধরনের পরীক্ষা নিরিক্ষা। এই পরীক্ষায় শিশু দুটির মাথার জয়েন্ট নার্ভ আলাদা ভাবে ব্লক করে দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখেন চিকিৎসকরা।

পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ ভাবে সফল হওয়ায় আগামী অক্টোবর/নভেম্বর মাসে তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের মাথা আলাদা করণের ফাইনাল অপারেশন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে।

সরেজমিন চাটমোহর উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকায় শিশু রাবেয়া রোকাইয়ার গ্রামের বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় হাঁসি খুশি যমজ শিশু দুটি এক সাথে বাড়ির উঠানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হবার উপায় নেই মাথা জোড়া লাগানো থাকায় তাদের চলতে ফিরতে অসুবিধা হচ্ছে।

মনের আনন্দে হাটি হাটি পা পা করে উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের দু’জনের এখন বয়স প্রায় আড়াই বছর। সুন্দর ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলে। পরিবারের সদস্যরা এবং আশপাশের প্রতিবেশীরাও তাদের ভীষণ ভালবাসে। আধ আধ কণ্ঠে ছড়া কবিতাও বলতে পারে তারা।

জিজ্ঞেস করা হয় তোমরা কেমন আছো? কেমন লাগে তোমাদের। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আমরা ভাল আছি। আরো বলে, জানো কাকু ডাক্তার আমাদের মাথা কেটে দেবে বলেই দৌড়।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার আটলংকা গ্রামের শিক্ষক দম্পতি রফিকুল ইসলাম-তাসলিমা খাতুনের সন্তান রাবেয়া-রোকাইয়া। ২০১৬ সালের ১৬ জুন সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম হয় এই মাথা জোড়া যমজ কন্যার।

বর্তমানে তাদের বয়স আড়াই বছর। এই দম্পতির সংসারে রয়েছে ৮ বছরের আরো একটি কন্যা সন্তান। স্বাভাবিক শিশুর মতো আচরণ এই জমজ শিশুর। স্বপ্ন ছিল সুস্থ, স্বাভাবিক শিশু নিয়ে আনন্দে ভরে উঠবে সংসার।

কিন্তু মাথা জোড়া থাকায় তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটলেও এখন আশার আলো দেখছেন এই শিক্ষক দম্পতি। তবুও তাদের সন্তান দুটি সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা না হওয়া পর্যন্ত চিন্তা যেন পিছু ছাড়ছে না তাদের।

মাথা জোড়া যমজ শিশুর বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, আগে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে ভীষণ ভাবে মানষিক টেনশনে থাকতাম। এখন আর তেমন কোন টেনশন করতে হয় না। সরকারের সহযোগীতায় আমাদের বাচ্চাদের পৃথকীকরণে ডাক্তাররা ভীষণ আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারী পরীক্ষা সফলতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। এতে করে চিকিৎসকরাও আশাবাদী তাদের সফল ভাবে পৃথকীকরণে। আমি আমার বাচ্চা দুটির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।

প্রতিবেশিরা জানান, মাথা জোড়া যমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়ার মতো ফুটফুটে বাচ্চাদের এমন অবস্থা মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টের। হাসি খুশি যমজ মেয়ে দুটিকে তারা সবাই ভালবাসেন এবং আশায় আছেন ভাল ভাবে যেন তারা আলাদা হয়ে তাদের মাঝে ফিরে আসে।

শেয়ার করুন: