যারা কাবা ঘর ধ্বংস করতে গিয়েছিল, তারাই ধ্বংস হলো! বিস্তারিত পড়ুন...

কাবা প্রাঙ্গনে ছুটছে মহান আল্লাহর মেহমানরা। প্রেম নিবেদনে আকুল মন দিল। হাজরে আসওয়াদের চুমুতে ঝরবে সব পাপ পঙ্কিলতা। মহান আল্লাহর রহমত ও বরকতে সিক্ত হবে দেহ ও মন।

কাবার প্রতি এমন প্রেম নিবেদন নিয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজীরা ছুটে যান। চোখের অশ্রুতে ভিজিয়ে দেন কাবা প্রাঙ্গন। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলেন মক্কার আকাশ বাতাস।

তবে মহান আল্লহর ঘর এ কাবাকে ধ্বংস করার জন্যও একদল বাহিনী ছুটে গিয়েছিল। ইতিহাস এদেরকে আসহাবে ফীল বা আবরাহা বাহিনী নামে চিনে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আবরাহা বাহিনীর কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে-

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ

আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তীবাহিনীর সাথে কিরুপ ব্যবহার করেছেন?

أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ

তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?

وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ

তিনি তাদের উপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী,

تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ

যারা তাদের উপর পাথরের কংকর নিক্ষেপ করছিল।

فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ

অত:পর তিনি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন। -(সূরা: আল ফীল)

বিভিন্ন হাদীসে এ ঘটনাটির বিবরণ এসেছে। মাআরেফুল কোরআনেও সূরাটির ব্যাখ্যায় ঘটনাটি তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে ঘটনাটির বর্ণনা এভাবে এসেছে, ইয়েমেনের গর্ভনর নিযুক্ত হলেন আবরাহা। ইয়েমেন দখল করার পর আবরাহার ইচ্ছা হলো, সে তথায় এমন একটি বিশাল সুরম্য গির্জা তৈরি করবে, যার নমুনা পৃথিবীতে নেই।

এতে তার উদ্দেশ্যে ছিলো, ইয়ামেনবাসীরা প্রতি বছর হজ করার জন্য মক্কা শরীফে যান এবং বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করেন। তারা এই গির্জার মাহাত্ম্য ও জাঁকজমকে মুগ্ধ হয়ে বাইতুল্লাহ শরীফ এর পরিবর্তে এই গির্জায় আসবে। এই ধারণায় সে এক বিরাট সুরম্য গির্জা তৈরি করলো।

নিচে দাঁড়িয়ে কেউ এই গির্জার উচ্চতা মাপতে পারতো না। স্বর্ণ-রৌপ্য ও মূল্যবান হীরা, জহরত দ্বারা কারুকার্যখচিত এই গির্জা তৈরি করার পর সে ঘোষণা করলো, এখন থেকে ইয়ামেনের কোনো বাসিন্দা হজের জন্য কাবা শরীফে যেতে পারবে না। এর পরিবর্তে তারা এই গির্জার মধ্যে ইবাদত করবে।

আদনান, কাহতান ও কুরাইশ গোত্রের মধ্যে এই ঘোষণার ফলে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তীব্রতর হয়ে উঠলো। কারো মতে, তাদেরই কেউ রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে গির্জায় ঢুকে ইস্তিঞ্জা করলো।

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে যে, তাদের এক যাযাবর গোত্র নিজেদের প্রয়োজনে গির্জার পাশে আগুন জ্বালালো। সে আগুন গির্জায় লেগে যায় এবং গির্জার মারাত্মক ক্ষতি হয়।

আবরাহাকে খবর দেয়া হলো যে, জনৈক কুরাইশি এ কাজ করেছে। তখন সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শপথ করলো! আমি কুরাইশদের কাবা শরীফ নিশ্চিহ্ন না করে ক্ষান্ত হবো না। নাউযুবিল্লাহ!

অত:পর সে এর প্রস্তুতি শুরু করলো এবং আবিসিনিয়ার বাদশাহর কাছে অনুমতি চাইলো। বাদশাহ কেবল অনুমতিই দিলো না বরং তার ‘মাহমুদ’ নামক খ্যাতনামা হাতিটিও আবরাহার সাহাযার্থে পাঠিয়ে দিলো।

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, এই হাতিটি এমন বিশাল আকৃতির ছিলো যে, এর সমতুল্য কোনো হাতি সচরাচর দেখা যেতো না। এ ছাড়া আরো আটটি হাতি এই বাহিনীর জন্য বাদশাহর পক্ষ থেকে পাঠানো হলো।

এসব হাতি পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল কাবা শরীফ ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করা। পরিকল্পনা ছিলো এই যে, কাবা শরীফের স্তম্ভে লোহার মজবুত ও লম্বা শিকল বেঁধে দেয়া হবে। অত:পর সে সব শিকল হাতির গলায় বেঁধে হাঁকিয়ে দেয়া হবে। ফলে গোটা কাবা শরীফ মাটিতে ধসে পড়বে।

কাবা বিদ্বেষী বাদশাহ আবরাহা প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠল। প্রতিশোধ নেব আমি। ধ্বংস করে দেব মক্কার ওই কাবা। সেনা-সৈন্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে সে অগ্রসর হলো কাবা ধ্বংসের অভিযানে।

দীর্ঘপথ অতিক্রম করে শিবির গাড়ল এসে মক্কার প্রান্তদেশে, হারাম সীমা-সংলগ্ন ওয়াদিয়ে বতনে মুহাস্সাবে। পরিকল্পনা হলো, এখানে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকালে হারামের সীমানা চিহ্ন পেরিয়ে অভিযান চালাবে মক্কায়, ধ্বংস করবে কাবা।

হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ ও কাবা ধ্বংসের জন্য বাদশাহ আবরাহা আসছে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল মক্কাবাসী। তার মোকাবেলা করবে এমন শক্তি-সামর্থ্য তাদের নেই। সিদ্ধান্ত হলো, আক্রমণকালে বাড়িঘর ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে উঠে প্রাণ বাঁচাবে তারা।

প্রিয় নবী (সা.) এর দাদা আবদুল মুত্তালিব তখন কুরায়েশদের প্রধান নেতা, কাবার প্রধান অভিভাবক। দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি ছুটে গেলেন কাবায়, প্রবেশ করলেন অভ্যন্তরে। হৃদয় ফেটে যাচ্ছে তার। আবেগাপ্লুত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কাবার খুঁটি, কান্নাভেজা কণ্ঠে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন তিনি কাবার মালিকের দরবারে।

বলতে লাগলেন, আমরা জানি কারো ঘর শত্রু আক্রমণ করলে সে তার মোকাবেলা করে নিজ ঘর রক্ষা করে। তোমার ঘর ধ্বংস করার জন্য আসছে আবরাহা।

সাধ্য থাকলে আমরা তোমার ঘর কাবাকে রক্ষা করতাম। কিন্তু সে সাধ্য আমাদের নেই। হে ঘরের মালিক, তুমি তোমার ঘর কাবাকে রক্ষা করো। এভাবে করুণ ফরিয়াদ জানিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।

ওদিকে বতনে মুহাসসাবে শিবির সন্নিবেশিত করে আবরাহা অপেক্ষা করতে লাগল। তার সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল পার্শ্ববর্তী প্রান্তরে সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছিল আবদুল মুত্তালিবের একটি উটের পাল।

আবরাহা বাহিনী তা লুট করে নিয়ে গেল। সংবাদ পেয়ে আবদুল মোত্তালিব ছুটে গেলেন উট উদ্ধারের জন্য আবরাহার শিবিরে। কুরায়েশদের মহান নেতা মুত্তালিবের ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক ভাবগম্ভীর সৌম্যকান্তি দেখে অভিভূত হলো আবরাহা।

স্বাগত জানিয়ে, সম্মানে আসন দিয়ে জিজ্ঞাসা করল তার আগমনের হেতু। আবদুল মুত্তালিব বললেন, আপনার সৈন্যরা আমার ২০০ উট লুট করে নিয়ে এসেছে এখানে, তাই ফেরত নিতে এসেছি আপনার কাছে।

এ উত্তর প্রত্যাশিত ছিল না আবরাহার কাছে। সে বলল, আপনি কুরায়েশ নেতা, মক্কা ও কাবার অভিভাবক, আগামীকাল আমি মক্কায় অভিযান চালাব, আপনাদের কাবা ধ্বংস করব। আমি ভেবেছিলাম কাবা রক্ষার আবেদন জানাবেন আপনি আমার কাছে। তা না করে সামান্য ক’টি উট ফেরত চাইতে এসেছেন আপনি!

শান্ত ধীরকণ্ঠে আবদুল মুত্তালিব বললেন, হ্যাঁ, উটই নিতে এসেছি। কারণ উটের মালিক আমি। উটগুলো উদ্ধার করা আমার কাজ। কাবার মালিক যিনি তিনিই রক্ষা করবেন তাঁর ঘর কাবা।

আবরাহা ফেরত দিলো উটগুলো এবং আবদুল মুত্তালিব সেগুলো নিয়ে ফিরলেন মক্কায়। প্রভাত হলো। আবরাহা অভিযানের নির্দেশ দিল। অগ্রে হস্তিবাহিনী। পুরোভাগে তার প্রধান রাজহস্তি মাহমুদ। অগ্রসর হলো মাহমুদ। অগ্রসর হলো তার পশ্চাতে অন্য হস্তিরা ও বিশাল বাহিনী।

কিন্তু একি! হারাম সীমা চিহ্নিত স্থানে এসে মাহমুদ থমকে দাঁড়াল, শুয়ে পড়ল। শত চেষ্টা করেও তাকে আর উঠানো গেল না। কাবার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো তার ইয়েমেনের দিকে, চলতে শুরু করল সে স্বাভাবিকভাবে। আবার মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হলো কাবার দিকে। কিন্তু ঐ সীমায় এসে সে বসে পড়ল আগের মতোই। তার সঙ্গে অন্য হস্তিরাও।

চলছে সামনে আগানোর প্রচেষ্টা। এমন সময় দেখা গেল, লোহিত সাগরের দিক থেকে ধেয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে (আবাবীল) পাখি। ছেয়ে ফেলল তারা বাহিনীর মাথার উপরের আকাশ।

আবাবীল চঞ্চু ও পায়ে বয়ে আনা পাথর-কঙ্কর বর্ষণ করতে লাগল বৃষ্টি ধারার মতো। এবং ‘ফা-জা‘আলাহুম কা‘আসফিম মাকুল’ চর্বিত, ভক্ষিত তৃণের ন্যায় তারা ধ্বংস হয়ে গেল।

এ ঘটনা প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের মাত্র ৫০ দিন আগের। এ ঘটনা এতই প্রভাব সৃষ্টিকারী যে, আরবরা এ থেকে নতুন সাল গণনা শুরু করল এবং তার নামকরণ করল হস্তি সাল।

তথ্যসূত্র: মায়ারেফুল কোরআন, (সূরা- ফীল)।

শেয়ার করুন: