চঞ্চল চৌধুরী

খুব সূক্ষ্ম একটি সুতার উপর থেকে গিয়েছি: চঞ্চল চৌধুরী

বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা ‘আয়নাবাজি’। বছর দুই আগে সে ছবিতে অভিনয় করে রীতিমতো প্রশংসায় ভেসেছেন চঞ্চল চৌধুরী। নাটকে নিয়মিত হলেও বড় পর্দায় তার দেখা মেলে দীর্ঘ বিরতির পর।

অভিনেত্রী জয়া আহসান প্রযোজিত ও অনম বিশ্বাস পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘দেবী’ তে ‘মিসির আলী’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯ অক্টোবর ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। তার আগে মুখোমুখি হয়েছেন প্রশংসিত এ অভিনেতা।

দর্শক কেন দেখবেন ‘দেবী’?

চঞ্চল চৌধুরী: আমার মনে হয় এতটা দিনে দর্শকের কাছে আমার এক ধরনের গ্রহনযোগ্যতা তৈরী করেছে। সেই জায়গা থেকে আমার কাজের প্রতি এক ধরনের আস্থা আমি নিজেই ফিল করি। পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে ফেসবুক বা স্যোসাল মিডিয়ার নানা মাধ্যমে কমেন্টসের মাধ্যমে সেটা পাই। তারা প্রতিনিয়ত জানাচ্ছেন, আপনার সিনেমা নির্বাচন করার প্রতি আমাদের আস্থা আছে।

আপনি নিরাশ করবেন না। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি ‘আয়নাবাজি’র পর এই ছবিটা। ‘আয়নাবাজি’ যে দর্শকশ্রেনী দেখেছেন। তাদের একটা বড় অংশ এই ছবিটা দেখতে আগ্রহী হবেন।

জয়া আহসানের দুই বাংলা মিলিয়ে অনেক অর্জন রয়েছে। দুই বাংলা মিলিয়ে ন্যাশনাল আওয়ার্ড থেকে শুরু করে ও শতভাগ প্রশংসিত অভিনেত্রী। অভিনেত্রী হিসেবে বর্তমান সময়ে সে সেরাদের একজন। সে জায়গা থেকে ওর কারণেও কিছু দর্শক আসবে।

মেকিং নিয়ে যদি কিছু বলতেন…

দর্শকের কাছে সবচেয়ে ভালো লাগবে মেকিংটা। খুব আধুনিক মেইকিং। অনম বিশ্বাস যার জন্য সাধুবাদ পাবে। এর টেকনিক্যাল কাজগুলো যারা করেছেন, ক্যামেরায় ছিলেন কামরুল হাসান খসরু। মনুপরায় সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। সে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ওয়ান অব দ্যা বেস্ট ক্যামেরাম্যান। সেই সঙ্গে ক্যামেরার পেছনে অন্যন্যরা যারা কাজ করেছেন।

সাউন্ড থেকে শুরু করে যতটুকু আমি দেখেছি আমার মনে হয়েছে সিনেমাটি আমাদের সিনেমাকে একধাপ এগিয়ে নিবে। আর গল্পটা তো মোটামুটি সবার জানাই। গল্প নিয়ে তো আর নতুন কোন ব্যাখ্যা নেই। যেমন আয়নাবাজির একটা গল্প ছিল যেটা দর্শক দেখার পরে বুঝতে পেরেছে। এই গল্পটা আগে থেকেই হাজার হাজার লাখ লাখ পাঠক জানে।

একটু নাকি পরিবর্তন আছে গল্পতে?

সময়, স্থান কাল পরিবর্তন আছে কিছুটা। সেটা আজ থেকে ২০ বছর আগের উপন্যাস। অনেক কারেকশন করতে হয়েছে। ওই সময়টাকে তো এখন হান্ডেড পার্সেন্ট ধরা সম্ভব নয়। আর উপন্যাস হুবহু ধরে সিনেমা নির্মাণ করা সম্ভব হয় না। কারণ ছবিতে নির্মাণ শৈলী থাকে। যা দিয়ে দর্শকের সামনে বইয়ের অক্ষরগুলো জীবন্ত করতে হয়। ক্যামেরার ভাষা আর লেখার ভাষা এক নয়।

গল্পের প্রয়োজনে কিছুটা তো পরিবর্তন করতেই হয়েছে। তবে মূল গল্পটাকে যতটা সম্ভব ধরে রাখা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দর্শক নানা রকম তর্ক বিতর্ক করছেন। তারা মেলানোর চেষ্টা করছেন উপন্যাসের সঙ্গে। এই জায়গা থেকে আসলে দর্শকের একটু ছাড় দিতে হবে।

দর্শক যেটা পড়ে আসছে। সেটাই পাবে না। কিন্তু যতটা পেরেছি তার সঙ্গেই ছিলাম। তারা যেন হান্ডেড পার্সেন্ট উপন্যাসের সঙ্গে সিনেমাটি না মেলায়। গল্পের সঙ্গে চমৎকার একটা উপস্থাপন হয়েছে। সেটা দেখুক ও তা নিয়ে কথা বলুক। ‘দেবী’ সিনেমায় বাংলা সিনেমাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে বিশ্বাসটা আমার মুখের কথায় রাখুক দর্শক।

সহশিল্পী এবং প্রযোজক হিসেবে জয়া আহসান কেমন?

আমি আসলে প্রযোজক হিসেবে ওকে কখনো গননা করিনি। কারণ ওই কতৃত্বই ও কখনো ফলাতে যায়নি। ও আমার নাটকেও সহশিল্পী হিসেবে ছিল। সিনেমাতে এই প্রথম সহশিল্পী হিসেবে কাজ করলাম। আমার বিবেচনায় ও সহশিল্পী।

আর প্রযোজক হিসেবে যে দায়িত্বগুলো পালন করা দরকার। সেটা সে পালন করছে। খুব ভালো ভাবেই করেছে। বিশেষ করে ওর প্রমোশনাল স্ট্রাটিজি দেখে আমি অবাক। আমার ব্যাপারটি বলবো, ওর কোন সত্তার সঙ্গে কোন সত্তা ক্লাশ হয়নি।

অভিনেত্রী জয়া আহসানকে আপনি কত মার্ক দিবেন ও প্রযোজক হিসেবে কত মার্ক দিবেন?

পরিমান না করি। সর্বোচ্চ (হাসি)

মিসির আলীর কথা মনে হলে আমাদের মাথায় পঞ্চাশোর্ধ একটি চরিত্র ভাসে, আমরা যেমন আগে আবুল হায়াৎ কিংবা আবুল খায়েরকে দেখেছি। এই চরিত্রটা রুপায়ন করার জন্য আপনি নিজেকে কিভাবে তৈরী করেছেন? আপনি তো ওই বয়সের না…

যখন কোন জীবিত মানুষের বায়োপিক করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ ওই মানুষটার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করবে। যখন একটা উপন্যাসের চরিত্র রুপায়ন হয়। যেমন দেবদাসকে আপনি কি বলবেন। দেবদাস তো দীলিপ কুমার,বুলবুল আহমেদও করেছেন,শাহরুখ খানও করেছেন। এখন কোন দেবদাসের সঙ্গে কি কোন দেবদাসের মিল আছে?

তাহলে আমরা মিসির আলীর সঙ্গে কেন আবুল হায়াত ও চঞ্চল চৌধুরিকে মিলিয়ে ফেলবো! হায়াৎ ভাই বা আবুল খায়ের সাহেব। ওনারা অনেক বড় মাপের অভিনেতা। ওনারা সে সময় ওই চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেয়েছেন। আর আমার যে চেহারার আদল। আমিও চেষ্টা করেছি ওই চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে।

টিজারে আমরা যে ভয়েসটা শুনলাম, এর আগে চঞ্চল চৌধুরির এমন ভয়েস কখনো শুনিনি। একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা, ভারিক্কি..

এটা একদম মিসির আলীর চরিত্রের জন্যই আলাদাভাবে আমার ভয়েস তৈরী করেছি। অনেক সময় হয় কি আমরা একটা চরিত্র যখনই চোখের সামনে দেখি। যখন সে ডায়লগ থ্রো করে, হাটা চলা কিংবা মুভমেন্ট করে সংলাপ বলে। তখন তার ভয়েসটা তার বডি ল্যংগুয়েজের সঙ্গে যাওয়া না যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। আমার যে লুক ছবিটিতে, সেই লুকের সঙ্গে আমার সাধারন ভয়েসটি যায়নি।

সেই যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আমরা অনেক গবেষণা করেছি। মিসির আলীর যে লুকটা আমরা ফিক্সড করেছি। সেই লুকের সঙ্গে আমি চঞ্চল চৌধুরি স্বাভাবিকভাবে যে সংলাপ বলি।

ওটা তো চঞ্চল চৌধুরির কথা হবে। মিসির আলীর কথা হবে না। এই বিবেচনা করে আমরা অনেক কষ্ট করে ভোকালটা পরিবর্তন করেছি। অনেক গবেষণা করে এই ভোকালটা তৈরী করেছি।

যেমন প্রথমে একটা ভোকালে ডাবিং করেছিলাম পুরো ছবিটা। সেই ভোকালটা একটু লাউড ছিল। পরে আবার আমরা বসে ভাবলাম শতভাগ ক্যারেক্টারের সঙ্গে মিলছে না।

যেটা আমি সব সিনেমার ক্ষেত্রেই ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করি। যেটা আমি আয়নাবাজির ক্ষেত্রেও প্রত্যেকটা চরিত্রেরই কিন্তু আলাদা ভোকাল ছিল। আমার নিজস্ব আয়না চরিত্রের একটা আলাদা ভোকাল ছিল।

ভয়েসটা নির্ভর করে তার যে লুক। সেই লুকের সঙ্গে ম্যাচ করে কিনা। আমাদের অনেক অভিনয়শিল্পী ভিন্ন ভিন্ন ক্যারেক্টার করে। কিন্তু যখন যে সংলাপ বলে। তখন এই ভয়েসে ভ্যারিয়েশন আনতে পারে না বলে চোখের সামনে তার অরিজিন্যাল চেহারা ভেসে আসে। ভিন্ন ইমেজে তাকে আর দেখা যায় না।

সেই জায়গা থেকে আমরা ভেবেছি মিসির আলী যখন দেখবে। মিসির আলীর ভোকালটা যেন নতুন কোন ভোকাল হয়। মিসির আলীর গেটআপের সঙ্গে মানানসই।

মিসির আলী ছাড়া দেবীর আর কোন চরিত্রটা আপনার পছন্দ। অফার পেলে ওই চরিত্রটাও আপনি করতেন?

অবশ্যই দেবীর রানু চরিত্রটা আমার পছন্দের। আরেকটা হচ্ছে যেটা ইরেশ যাকের করেছে। বাসেদ চরিত্রটি। এটার মধ্যে অনেক ডাইমেনশন আছে। নেগেটিভ ক্যারেক্টার যদিও।

আপনি অভিনয় করেছেন, এমন একটি দৃশ্য বর্ণনা দেন। যেটা আপনার কাছে অসাধারণ লেগেছে…

অসাধারণ কথাটা আমি কখনো বলতেই চাই না আমার কাজ দিয়ে। আমার কোন অভিনয় নিয়ে বলতে চাই না এই অংশটকু অসাধারণ। ‘দেবী’ সম্পর্কে তো আমি বলতেই পারবো না। ‘আয়ানাবাজি’ সম্পর্কে আমি বলতে পারি। দেবী নিয়ে আমি বলতে পারবো হলে রিলিজ হলে। আমি আরও অনেকবার দেখে বেছে নিতে পারবো এই অংশুটুকু ভালো লেগেছে।

আয়নাবাজিতে যেটা ছিল নেতার একটা চরিত্র ছিল। চেয়ারে বসে সে সংলাপ বলে। এই জায়গাটা কেন যেন আমার একটু বেশি ভালো লেগেছে। আর মিসির আলীর প্রত্যেকটা লাইনে লাইনে আমরা এতবেশি ইনপুট দেয়ার চেষ্টা করেছি।

এটা খুব সূক্ষ্ম একটি সুতার উপর থেকে গিয়েছি আমরা। দর্শকের ভালো লাগার জায়গাটাই যেন থাকে গল্পের টানটান উত্তেজনা। দর্শকই বিচার করুক কোন অংশ বা চরিত্রটি তাদের ভালো লেগেছে।

শেয়ার করুন: