দিন যাচ্ছে মানসিক রোগ যেন মাথা চারা দিয়ে উঠেছে সেলিম মন্ডলের।রাত গভীর হয় আর আর ঘুমেরে মধ্যে হাত পা ছুঁড়ে পাগলের প্রলাপ বকেন সাভারের কুখ্যাত চাঁদাবাজ,খুনী,সন্ত্রাসী সেলিম মন্ডল।
তাকে বাঁচাতে বিশেষ মিশনে নেমেছিলো সেলিম মন্ডলের ভাই বেরাদাররা। রীতিমতো নিলাম তোলার মতোই ঘুষ সেধেছিলো সেলিম মন্ডলের সহযোগীরা। কিন্ত শেষ রক্ষা আর হয়নি।
কত ট্যাকা লাগবো ? ১০ লাখ,২০ লাখ,৩০ লাখ। তারপর এক লাফে দর উঠে যায় ৫০ লাখ টাকা। সাভার উপজেলা যুবলীগের বহিস্কৃত সভাপতি ও ঢাকা জেলা পরিষদের সদস্য সেলিম মন্ডলকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশা আক্তার বকুল হত্যা মামলা থেকে বাঁচাতে এমন প্রস্তাবই দেয়া হয়েছিলো পুলিশকে।
‘কি ভাবেন পুলিশকে। ছেলের হাতে মোয়া না পুতুল? আপনার সমস্ত কথা আমার ফোনে রেকর্ড হয়েছে। আবার যদি এমন সাহস দেখান তাহলে আপনাকেও মামলায় ঢুকিয়ে জেলে ভরবো’- সেদিন রাম ধমক দিয়ে ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব এভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন।
ফোনের অপর প্রান্তে থাকা কুখ্যাত সেলিম মন্ডলের স্বজনকে রাম ধমক দেবার পর আর কেউ তাকে নূন্যতম তববির করার সাহস-ও পায়নি। সেদিন বিবেকের বেচাকেনার হাটে নিজের বিবেক ও সততাকে টাকার কাছে বিক্রি করেননি এসআই আনোয়ার হোসেন।
বরং ৫০ লাখ টাকার ঘুষের প্রস্তাবকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে নিজের সাহস আর সততার জোরে রীতিমতো গহীন অন্ধকার থেকে তুলে এনেছেন আলো। তার নিবিড় তদন্তে কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে এসেছে কেউটে থেকে বিষধর গোখরা সাপ।
যে গোখরা সাপের নাম সেলিম মন্ডল। যাকে বলা হচ্ছে,সাভারে যুবলীগের রাজনীতিতে এক অভিশপ্ত ইতিহাস। তার চাঁদাবাজীর ছোবলে কেউ পঙ্গু হয়েছেন শারিরীকভাবে কেউ বা পঙ্গু হয়েছেন আর্থিকভাবে।
অথচ সেদিন ৫০ লাখ টাকা গ্রহণ করলে এসআই আনোয়ার সাভারে আজ একটি অভিজাত ফ্ল্যাটের মালিক হতেন। নচেত আকর্ষনীয় জায়গায় অন্তত ১০ কাঠা জমির মালিক হতে পারতেন। কিংবা ৫০ লাখ টাকার এফডিআর করে নিজের ভবিষ্যতটাও নিরাপদ করতে পারতেন।
কিন্তু না। এর কোন পথেই হাটেঁন নি এসআই আনোয়ার হোসেন।
রাজনৈতিক প্রভাব আর চাপ মোকাবেলা করে সত্যকে দৃঢ় চিত্তে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তিনি। স্যালুট পুলিশের গর্ব এসআই আনোয়ার হোসেন।
কৌতুহল থেকে তাকে প্রশ্ন করি,কিভাবে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের ক্লু বের করলেন?
জবাবে এসআই আনোয়ার হোসেন জানালেন,‘বিকৃত লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় সনাক্তে বিভিন্ন থানায় থানায় লাশের ছবি পাঠিয়ে ম্যাসেজ দিলাম। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না।
একই সাথে বিভৎস লাশের ছবি পোষ্ট করলাম নিজের ফেসবুক আইডিতে। দেখা গেলো ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের নীতিমালার কারণে ওই ছবিটাও সরিয়ে দিলো।ভাগ্য ভালো লাশটি উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় কেবল মুখটা অক্ষত ছিলো। অতপর:সেই মুখের ছবিটাই ফেসবুকে দিয়ে অদ্ভূত সাড়া পেলাম।
জানতে পারলাম নিহত নারীর নাম। তার মোবাইল ফোন নম্বর পেয়েই ট্র্যাক করলাম। দ্রুত পেয়ে গেলাম,হত্যাকান্ডের পূর্ব মূহৃর্তে সেলিম মন্ডলের সাথে বকুলের একের পর এক কলের লিষ্ট।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম সেলিম মন্ডলকে গ্রেপ্তার করার। এসপি স্যারকে বিষয়টি জানালাম। স্যার বললেন,একেতে সাভার উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবার জেলা পরিষদের সদস্য। ভেবে চিন্তে অগ্রসর হতে হবে।
এরই ফাঁকে এসপি স্যার ডিআইজি স্যারকে বিষয়টি জানালেন। বিস্তারিত জেনে ডিআইজি স্যার বললেন,যুবলীগের সভাপতি হয়েছে তো কি হয়েছে। তাকে তো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যেও আটক করা যেতে পারে।
শুরু হলো অভিযান। সাভার মডেল থানাকেও জানালাম না। নিজেই সাহস নিয়ে মোটরসাইকেল করে গেলাম বিরুলিয়ায়।
মনে হলো এই গাড়িতেই ধরতে পারবো মন্ডলকে। আমার অভিযানের মুখে গাড়ির গতি বেড়ে গেলো। ধাওয়া করে নিয়ে গেলাম শামাইর পর্যন্ত। গাড়ি থেকে নেমেই ঝেড়ে দৌড় দিলো সেলিম মন্ডলের ছোট ভাই জুয়েল মন্ডল।অস্ত্রসহ আটক করা হলো তাকে।
আমার প্রশ্ন সেদিন কেন দৌড় দিয়েছিলো জুয়েল মন্ডল?
আসলে সবই পাপের ফসল। আসলে ওদের কারো মধ্যেই অনুশোচনা আসেনি। অহংকারই ডেকে নিয়ে এসেছে ওদের পতন। এভাবেই অভিযানের গল্প এগিয়ে যেতে যেতে থাকে।
আনোয়ার হোসেন বলেন,এদিকে যখন সেলিম মন্ডলকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছি,তখন হাইকোর্ট থেকে এক আইনজীবির প্রত্যায়ন করা একটি আদেশ পেলাম। যেখানে উল্লেখ করা ছিলো,সেলিম মন্ডলকে আটক কিংবা হয়রানী করা চলবে না।
উচ্চ আদালতে আদেশ বলে কথা। সবাই ওপরে আদালত।তাই কৌশলের আশ্রয় নিতে হলো।
ইতোমধ্যে বেশকিছু এভিডেন্স হাতে এলো।
যাতে সেলিম মন্ডলের যোগসূত্রের বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। পাশাপাশি আদালতের এ আদেশ পেয়েই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেলো ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না প্রবাদটির কথা। আরো নিশ্চিত হয়ে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক সেলিম মন্ডলকে পুলিশের জালে আনতে আনতে হবে।
এর মধ্যে সন্দেহের আরো একটি কারণ হলো,হাইকোর্টের অর্ডারশীট থানায় নিয়ে এসেছে খোদ পুলিশের এক কনষ্টেবল। যে কি’না আবার মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটরের দেহরক্ষি। সন্দেহ ঘনিভূত হলো।ততক্ষণে থানায় আইনজীবির প্রত্যায়ণপত্র জমা দিয়ে তারা চলে গেছে।
শোনামাত্রই ধল্লা চেকপোষ্টে ফোন দিলাম।তাদের আটক করা হলো।আমি দ্রুত পৌঁছে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ওই কনষ্টেবল হাতে পায়ে ধরা শুরু করলো।
তারপর তার সূত্রে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওই প্রসিকিউটরের মাধ্যমে আদালতের মূল আদেশ সংগ্রহ করে জানতে পারি,আদালত সেলিম মন্ডলকে কোন জামিন আদেশ দেয়া দূরের কথা। সে জড়িত না থাকলে তাকে গ্রেপ্তার বা হয়রানী করতে নিষেধ করেছিলো মাত্র।
এখানে প্রশ্নটা হচ্ছে জড়িত না থাকলে।ততক্ষণে মোবাইল ফোনের কললিষ্ট আর সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ আমার হাতে।
এরই মধ্যে দেশের সকল বিমান,নৌ আর স্থল বন্দরে জরুরী বার্তা পাঠিয়ে দিলাম।যাতে সেলিম মন্ডল দেশ ত্যাগ করতে না পারে।
শেষ পর্যন্ত আশংকাটাই সত্যি হলো। সেলিম মন্ডল ইটালী যাবার পথে ধরা পড়লো। তাকে থানায় নিয়ে ভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিম্যান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই বের হয়ে এলো থলের বেড়াল।
থানা হাজতে নিয়ে বললাম,সেলিম মন্ডল ঢাকা জেলার সাভার মডেল থানায় কাজ করার সুবাদে আমি তোমার আদ্যোপান্ত জানি।
তুমি তোমার মা কে নিয়ে হজ করে এসেছো। আল্লার ঘর তাওয়াফ করেছো। ভাগ্যে যা হবার হবে। তার আগে তুমি সত্য কথা বলো। অন্তত নিজের কাছে শান্তি পাবে।
আর নামাজটা ধরো।তারপর সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলো। এখন শুনছি,সে কারগারে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভূগছে।
কথায় বলে পাপ বেশীদিন চাপা দেয়া যায় না। হলোও তাই।সেলিম মন্ডলের পাপের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলেছিলো।
মদ,নারী আর চাঁদাবাজী। এই তিনেই অধপতন হয় তার। বকুল হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান,সেলিম মন্ডল তার মাকে নিয়ে হজ্ব করে আসার পর-ও তার চাল চলন বা কথাবার্তায় নূণ্যতম পরিবর্তন আসেনি।
আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে,সেলিম মন্ডল হজ করে আসার পর হাজীর পরিবর্তে আরো পাজী হয়েছে। বেপরোয়া হয়েছে। যার পরিণতি দ্বিতীয় স্ত্রীকে হত্যা করে সে এখন জেলে। সেখানে অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে এই সন্ত্রাসী মন্ডল।– বলছিলেন এস আই আনোয়ার।