bdview-Featured-image

হাসপাতালে বসে কি করছেন সেই সাফাত?

রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্স মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ। বিচারাধীন মামলায় সাফাত কারাগারে থাকলেও বুধবার তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। তবে হাসপাতালের পরিচালকের ওয়েটিং রুমে বসে সাফাতকে ব্যবসায়িক আলোচনা সারতে দেখা গেছে। বুধবার সকালে সাফাতকে হাসপাতালে আনা হয়। তাকে বসানো হয় হাসপাতালের পরিচালকের ওয়েটিং রুমে। এসময় তার ডান হাতে হ্যান্ডকাপ লাগানো থাকলেও তার দুই পাশের চেয়ারে গা ঘেঁষে বসে থাকতে দেয়া গেছে সাফাতের দুই আত্মীয়কে।

এসময় তাদের সঙ্গে ব্যবসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছে সাফাত। একই রুমে ছিলেনতিন কারারক্ষী। তাদের সামনেই কয়েকটি ফাইলে স্বাক্ষর করতে দেখা গেছে সাফাতকে। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত পরিচালকের ওয়েটিং রুমে দুই আত্মীয়ের সঙ্গে খোসগল্পে মেতে ওঠেন সাফাত। কিন্তু কারারক্ষীরা সাফাতকে সকাল বেলায় চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতালে আনে।

সেই সকাল থেকে বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত ওয়েটিং রুমের সব ক’টি চেয়ার দখল করে বসে থাকায় সাধারণ লোকজন কিংবা রোগীদের বসার সুযোগও ছিলো না। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের কেবিন পাওয়া নিয়ে কারারক্ষী মাসুদ রানার সঙ্গে সাফাতের এক আত্মীয়ের দুইবার বাগবিতাণ্ডাও বাধে। দেখা যায়, সাফাত তার দুই আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবসা, পরিবারিক এমনকি রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করছে। তার এক আত্মীয়কে সাফাত জিজ্ঞেস করছে, আমাদের বাড়িধারা ২নং রোডের দ্বিতীয় প্রজেক্টের কি অবস্থা?

উত্তরে তার আত্মীয় বলেন, মাত্র বেজমেন্ট হয়েছে। সাফাতের ফের প্রশ্ন- টাকা-পয়সা আসে? তার আত্মীয় বলেন, হ্যাঁ, আসে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার আত্মীয় সাফাতের কানের কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন। পরক্ষণে সাফাত বলে উঠলো, এটা… রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক কারণে এমন হয়েছে। তার আরেক আত্মীয় সাফাতের কাছে জানতে চান দুপুরে কি খাবে?

উত্তরে সাফাত বলে, একটা আনলেই হবে। ওই আত্মীয় বলেন, একটা কমেন্ট দেও। এতে সাফাত বলে, গরুর মাংস, সবজি এবং ডাল হলেই হবে। এ সময় ওই আত্মীয় পকেট থেকে ফোন বের করে কল করেন। অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে হানিফ নামে সম্বোধন করে সাফাতের জন্য খাবার আনতে বলেন। সাফাত ও তার আরেক আত্মীয়কে তিনি বলেন, রুমটার….পর্দা লাগাতে হবে। ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ধৌত করতে হবে। শুনলাম, রুমের ভেতরে থাকা পাইপ দিয়ে পানি ঝরছে। এসব ঠিক করতে হবে।

কথা বলার কিছুক্ষণ পর পর দুই আত্মীয় উঠে যাচ্ছেন। আবার এসে বলছেন, চেষ্টা চলছে, দেখা যাক। কারারক্ষীরা কিছুক্ষণ পর পর তাদের হাতে থাকা একটি ফাইল নিয়ে উঠে যাচ্ছেন। আবার এসে রুমে বসছেন। হঠাৎ কারারক্ষী একজনকে সাফাতের জিজ্ঞাসা কি অবস্থা? উত্তরে মাসুদ রানা বললেন, আপনি তো কেবিন পাবেন না। সাফাত বললো, কেন? তিনি বললেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে আপনাকে কেবিনের বিষয়ে কিছু লেখেনি। সাফাতের জিজ্ঞাসা, কেন, লেখা আছে তো ‘খালি সাপেক্ষে সিট দেয়া হোক’। তখন তিনি বলেন, তা তো লেখা আছে। কিন্তু কেবিন তো খালি নেই।

সাফাত বলে, তাহলে এই কাজটা কি নার্স করল? নাকি পরিচালক নার্সকে বলেছে? তখন চেয়ার টেনে সাফাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেন কারারক্ষী। তার হাতে থাকে ফাইল উল্টিয়ে সাফাতকে বুঝাতে থাকেন মাসুদ। এ সময় আরেক কারারক্ষী বলেন, এটি আইজি প্রিজন স্যার জানেন।

বেলা ১টার দিকে দুই আত্মীয়ের একজন বাহির থেকে ওয়েটিং রুমে ঢুকেন। তিনি একজন স্টাফের নাম সম্বোধন করে কারারক্ষী মাসুদ রান্নাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, সে (স্টাফ) বলেছে, কেবিনটা হতো, বাট আপনার কারণে হয়নি। এ সময় মাসুদ রানা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সাফাতের আত্মীয়কে বলেন, কি বললেন। আপনি কি বললেন? আমার কারণে হয়নি মানে। আপনি আমার সাথে চলেন। এ কথা কে বলেছে? তখন ওই আত্মীয় বলেন, আপনি (মাসুদকে) বসেন। আপনি দাঁড়ালেন কেন?

এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি আসামি? আমার ব্যাকগ্রান্ড সম্পর্কে জানেন? কারারক্ষী বলেন, সেটা বাদ দেন। কিন্তু আপনি এ কথা কেন বললেন। আমি কি ওনার (সাফাতের) কেবিনের জন্য কম চেষ্টা করেছি? এ সময় সাফাত, তার আরেক আত্মীয় এবং কারারক্ষী মান্নান ও আনোয়ার দুইজনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কারো কথা না শুনে এভাবে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি করেন।

একই বিষয় নিয়ে প্রায় ২০ মিনিট পর ফের দুইজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির মধ্যেই হাসপাতালের এক স্টাফ এসে বলেন, আপনি (সাফাত) বসেন। স্যার এখানেই আসবেন। এ সময় কারারক্ষী মাসুদ রানা তার হাতে থাকা ফাইল নিয়ে বের হন। ৪-৫ মিনিট পর ফিরে এসে বলেন, কাজ করছে, দেখা যাক। ওয়েটিং রুমেই বসে পুরো বিষয়টি দেখার পর কারারক্ষী মাসুদ রানাকে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করেন, ওনার (সাফাতের) কি ধরনের সমস্যা? মাসুদ বলেন, আছে। কিন্তু আপনি কে?

সাংবাদিক পরিচয় দিতেই বলেন, আপনি দেখছেন না..আমি বিষয়টা বলতে চাচ্ছি না। এ কথা বলেই তিনি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, চলেন আমরা প্রিজন ভ্যান গিয়ে বসি। এভাবে ৩/৪ বার বলার পর সাফাত বলে, আরে… বসেন, যাওয়া যাবে। এত অস্তির হলেন কেন। হঠাৎ করে সবাই চুপ হয়ে যান। বেশ কয়েক মিনিট ধরে কেউ কোন কথা বলছেন না।

অন্যদিকে কারারক্ষী মাসুদ একবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, আবার বসছেন। কেউ কিছু বলতে চাইলে তাকে ‘এসব আলোচনা এখানে না করাই ভালো বলে’ চুপ করিয়ে দিচ্ছেন। কারারক্ষী আনোয়ার সাফাতকে বলেন, আচ্ছা, এবার চলেন। সাফাতের একই কথা, আরে বসেন। ওরা…কি করে দেখি না। এ সময় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন।

বেলা ২টার দিকে সাফাতের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই, আমরা শরীরটা খুব খারাপ। পাইলস এর সমস্যা। এর আগে দুই বার বিদেশে অপারেশন করিয়েছি। এখন হাসপাতালে আসলাম। ডাক্তার ভর্তির কথা বলেছেন, অথচ সিট খালি নেই। আপনি যেহেতু একজন রিপোর্টার আপনি এটা নিয়ে (সিট না পাওয়ার বিষয়ে) লিখেন। এতে যদি মানুষের কষ্টটা একটু কমে। নিজে নিজেই প্রতিবেদককে বলেন, আমার পেইনের (ব্যথা) সমস্যাও আছে। হাতে ব্যথা। এক প্রশ্নে সাফাত বলেন, আমি এখনো নিদোষ। কেন না মামলাটি বিচারাধীন। কিন্তু সাফাত কথা বললেও কারারক্ষী মাসুদ ও আনোয়ার তাকে বারণ করছেন। এই প্রতিবেদকের ওপর ক্ষেপে যান এই দুই করারক্ষী।

সোয়া ২টার দিকে কারারক্ষী আনোয়ার সাফাতকে বলেন, সিগারেট খাবেন না বললেন, চলেন। এ বলে তারা তিনজন পরিচালকের ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে যান।

মিনিট দুয়েক পর তার দুই আত্মীয় এসে ওয়েটিং রুমে বসেন। সাফাতের কি ধরনের সমস্যা তাদের কাছে জানতে চাইলে এক আত্মীয় বলেন, পাইলস এর সমস্যা। তার পায়ুপথ দিয়ে রক্ত ঝরতো। তিন মাস আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। সেটা ভালো হয়েছে। তাহলে এখানে কেন আনা হয়েছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আবার ডাক্তারকে দেখানোর জন্য আনা হয়েছে। ভালো হয়েছে নাকি সমস্যা রয়ে গেছে। সাফাতের সঙ্গে ব্যবসাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মূলত অনেকদিন পর দেখা হলো তো। তাই কৌতূহল থেকে সে (সাফাত) জানতে চেয়েছে। সাফাত তাদের সম্পর্কে কি হয়- এমন প্রশ্নে তারা তা বলতে অপরগতা প্রকাশ করেন। বলেন, একজন বাবার কূলের আত্মীয় আরেকজন মায়ের কূলের আত্মীয়। একজনের নাম ফরিদ, আরেকজন শৈবাল আহমেদ সরকার বলে নিজেদের পরিচয় দেন।

বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ-আল-হারুন এর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সাফাত হাসপাতালে এসেছে এটা জানবো না তা কি হয়? তাকে ডাক্তার আতিক দেখেছেন। তিনি তো ব্যবস্থাপত্রে স্পষ্ট লিখে দিয়েছেন, খালি সাপেক্ষো কেবিন দেওয়া হোক। তার (সাফাতের) লোকজন আমরা কাছেও দু’বার এসেছে। সে কেবিন পাওয়ার মত রোগী হলে এবং কেবিন খালি থাকলে পাবে। না থাকলে পাবে না। এদিকে সাফাতকে কেবিন পেতে সাহায্য করার বিষয়ে কারারক্ষী মাসুদ রানাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমরা ছোট কর্মকর্তা। আমাদের ডাক্তার (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের) বলছে, সাফাতের চিকিৎসার দরকার। তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে নিয়ে আমাদের হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।

শেয়ার করুন: